রঘুবীর সিং
অনুবাদ: আরফান আহমেদ
আলোকচিত্র যদি ভারতীয় আবিষ্কার হত, তাহলে আমার বিশ্বাস, পশ্চিমা আলোকচিত্রীগণ রঙে দেখাকে যেভাবে, তত্ত্বীয় ও শৈল্পিক সমস্যা হিসাবে গ্রহণ করেছেন তা কখনোই ওরকম হত না। রঙিন আলোকচিত্রকে খারিজ করার জন্য, অঁরি কার্তিয়ে ব্রেসো আড়ালে ফরাসি সেনাবাহিনীর খিস্তি ব্যাবহার করতেন, আর জনসমক্ষে বলতেন ওটা পেইন্টিং এর ক্ষেত্র। ওয়াল্কার ইভান্স রঙ্গীন আলোকচিত্রকে ঘোষণা করলেন অশ্লীল আর এন্দ্রে কার্তেজ তার বই এবং প্রদর্শনীতে কখনোই তার রঙ্গীন আলোকচিত্রগুলো ব্যাবহার করেন নি। যখন পুরো নতুন এক প্রজন্মের আলোকচিত্রীগণ রঙেকেই বেছে নিলেন, এ আলোকচিত্রীরা সাদা-কাল ছবির বিশেষ ও মূলগতঃ বৈশিষ্ট, তার দূরত্ববাচকতাকে রঙ্গিন ছবিতে এমনভাবে সংশ্লেষ করলেন, সেটি হয়ে উঠল আঙ্গিক ও আবেগের নতুন প্রকাশ।
ঔপনিবেশিকতার আগে এবং আলোকচিত্রেরও আগে, ভারতীয় শিল্পীগণ সাদাকালোতে কোনকিছুই দেখেননি, যদিও তারা রঙে পরিপূর্ণ সূক্ষ্ম ড্রইং তৈরি করেছেন। পশ্চিমে পরিচিত ড্রইং মাধ্যামটির অস্তিত্ব কখনোই ভারতে ছিল না নন্দনতাত্ত্বিক অথবা কৌশলগত ভাবে। ভারতের কখনোই কোন লিওনার্দো, রেঁম্ব্রা অথবা গয়া ছিল না। এমন কি মুঘল দরবারের অপরূপ সৌকর্যময় ড্রইং গুলো, পশ্চিমের ড্রইংগুলো থেকে একেবারে ভিন্ন। ওখানের ড্রইংগুলো সাধারনত রঙ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অথবা ‘ট্যান-ওয়াশ’ ব্যবহার করা হয়েছে যেমন ‘নীল কলম’। একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে যখন ষোল শতকে আকবরের দরবারে, উপঢৌকন হিসাবে, গোয়ার খৃস্ট্ সঙ্ঘ কাঠ-খোদাইয়ে প্যাকেট করে রয়েল পলিগলট বাইবেল প্রদান করে। চমক কেটে যাওয়ার পর, সম্রাট এবং তাঁর সভাসদগণ এবং শিল্পীগণ নিশ্চিত ভাবেই কল্পনায় কাঠখোদাইয়ের খালি যায়গাগুলো রঙে পরিপূর্ণ করে ছিলেন। জাহাঙ্গীরের জন্য তৈরি করা, সতের শতকের বিখ্যাত শিল্পকর্ম, ইনায়েৎ খাঁ-র মৃত্যুতে ছিল না অন্ধকার আমেজ অথবা ইউরোপীয় মহৎ শিল্পকর্মের মত আলো-ছায়ার কারসাজি। ড্রইং ছিল পেইন্টিঙের প্রস্তুতি। এ ধরণের ড্রইংগুলো,রাজকীয় সংগ্রহশালার বদলে পাওয়া যায় শিল্পীদেরই নিজস্ব সংগ্রহশালায়। আজ এ ধরনের ড্রইং অপ্রতুল, যে ধরনের ড্রইংগুলি উজ্জ্বল মুঘল আর রাজপুত পেইন্টিং এ, তাদের গৌণ ভুমিকার ইঙ্গিত দেয়।
প্রাচীন কাল থেকেই ইহুদী-নাসারা দুনিয়া, রঙ দেখেছে তাত্ত্বিক অগ্রগতির চোখ দিয়ে। চাগাল-এর সময় পূর্ব পর্যন্ত ইহুদী সভ্যতার রঙ এবং রেপ্রেজেন্টেশন সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না; সে সময়ে খৃস্ট সভ্যতাও রঙের প্রতি দেখিয়েছে বৈরীতা। ক্যেনেথ ক্লার্ক তার সিভিলাইজেশন বই এ আলাপ করেছেন, টার্নার এবং প্রকৃতির সাথে শিল্পের মনস্তাত্বিক সম্পর্ক বিষয়ে। তিনি এই বলে উপসংহার টানেন যে, ধারণা করা হত রঙ হল পাপাত্মক। হয়তোবা সত্যি, কারণ এটি হল তাৎক্ষণিক ভাবে উত্তেজনাকর এবং এটি নৈতিকতার ভিত্তি ক্রমিক স্মৃতি সমূহকে স্বাধীন ভাবে প্রভাবিত করে’। কলার এন্ড কালচার গ্রন্থে জন গেজ, রঙের নৈতিকতা সম্পর্কে পুরো একটি অধ্যায়ই লিখে ফেলেন, যা এরিস্টটোল থেকে শুরু হয়ে ক্যান্ডিন্সকি-তে এসে শেষ হয়। চার্লস এ. রিলে, কালার কোডস-এ বলেন, রঙ হল দুশ্চিন্তার উৎস…