মুসতাইন জহির
…হারাধন দে-র পূর্বসূরি, স্বজাতির মধ্যে ডাক্তার নারায়ণ দাজি (১৮২৮-১৮৭৫) যখন ক্যামেরা হাতে বের হন, তখন তিনিও এক প্রকার কর্তব্য কাজেই শরিক হন। তবে সে কর্তব্য তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের তরে খেটেছে অনেকটা! বিজাতির মধ্যে ইউলিয়ম জনসন আর বেনিয়ামিন সিম্পসনও এইকাজে ভূ-ভারতের ‘আদম’ সুরতের নমুনা সংগ্রহে নামেন সেই সময়। নমুনা সংগ্রহের এই প্রকল্প-কলোনির জ্ঞান ও বিজ্ঞান প্রযোজনা, প্রশাসন পরিচালনা এবং পরিসংখ্যান সাজানোর বর্ণবাদী ভাবধারার উদ্দেশ্য ও বিধেয়’র অন্তর্ভুক্ত। কলোনির লগে এথনোগ্রাফি চর্চার কায়কারবারে ফটোগ্রাফি কি যোগান দিতে আসে, সেই আলাপে যাওনের আগে নারায়ণ দাজির দলভুক্ত হওনের বিষয়টা একটু বইলা নেয়া যাইতে পারে। দাজি বম্বে মেডিকেল কলেজ থন পাশ কইরা বাইর হন ১৮৫২ সনে, তখনও ফটোগ্রাফি জিনিসটা হাঁটি হাঁটি পা পা, উদ্ভাবিত হইছে মাত্র তের বছর। এরই ভিতরে ১৮৫৪ সনে বম্বে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি আর তার দুই বছর পরে কলকাতা এবং মাদ্রাজে অর্থাৎ ১৮৫৬ সনে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি খাড়ায়া যায়। দাজি এলফিনস্টোন কলেজে ফটোগ্রাফিতে মাস্টারির সুযোগটা অল্পের জন্য হাত ছাড়া করেন। বম্বে ফটোগ্রাফিক সোসাইটির কাউন্সিল মেম্বার থাকেন, ১৮৫৭-৬১ পর্যন্ত। ভারতীয় আদম সন্তান (পিপল অব ইন্ডিয়া, ১৮৬৮-৭৫) নামে আট খণ্ডে যে বই বাইর হয় তার প্রথম খণ্ডে তার কাজ ছাপা হয়।
ভারতের ইতিহাসে ১৮৫৭ ইসায়ী’র সিপাহি বিদ্রোহ বা প্রথম ‘জাতীয় যুদ্ধ’ খ্যাত ইংরাজ বিরোধী সশস্ত্র পন্থা সরকার সামলে নিলে পরে, পুরাতন কায়দায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ক্ষমতা রাইখা উপনিবেশের এই ভাগটা শাসন-কর্তৃত্বে আর ধইরা রাখন যাইব না, সেই বিষয়ে রানীর সরকার নিশ্চিত হয়। শাসন-তান্ত্রিক কাঠামো আর প্রশাসনিক বিন্যাসে হাত লাগানোর ব্যাপারে তারা মনস্থ করে। এই ভাবনার প্রায়োগিক বন্দোবস্তে, বড় একটা দিক এন্তেজাম দিতে দরকার পড়ে সেনসাস বা আদমশুমারির। মাথা গোনার পাশাপাশি, কার মাথা কিভাবে কোন বর্গে ভাগ করবেন, বাটোয়ারায় কার লগে কারে মিলায়া কি পরিচয় দিবেন, কার মুখ কোনদিকে ঘুরাইবেন, সেই কাজে আরও জোরদার ভাবে বিশাল ভারতের কোনা-কাঞ্চি পর্যন্ত আদম সন্তানদের সম্প্রদায় গত আচার অভ্যাস, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ধার্য করণের কর্মযজ্ঞে ডাক পড়ে ফটোগ্রাফারদের। কারণ, উদ্ভাবনের পর থেইকা এই বিশ্বাসের জয়জয়কার হইতে থাকে যে, ক্যামেরাই একমাত্র জাদুযন্ত্র যা অবিকল, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশেষত্ব সহ প্রতিটা বিষয়ের আগাপাছতলা হুবহু গ্রেফতার করতে সক্ষম। বিবরণ এতই নিখাদ, নির্ভরযোগ্য ও চোখের অধিক বাস্তবতার (আটার ট্রুথ) তালাশ দিতে পারে, যাতে যাবতীয় সংশয় অমূলক হইয়া যায়। ফটোগ্রাফারের নিজের ইচ্ছা নিরপেক্ষ নিশ্চিত, নৈর্ব্যক্তিক রেকর্ড পাওয়া যায়। ক্যামেরা ফটোগ্রাফারের চোখ দিয়া দেখেনা, মানে ফটোগ্রাফার যা দেখেনা ক্যামেরার কাচ তাও দেখে এবং চোখ যা বাদ দিতে চায় ক্যামেরা তারেও টাইনা আনে। এই ক্ষমতা, মানুষের ইচ্ছার বাইরে গিয়া বাইরের দুনিয়া ধারণ করবার যে কেরামতি তারে মারগারেট ইভারসেন নাম দিছেন ক্যামেরার ‘জন্মান্ধ চোখ’। যে জানেনা সেন্সর কেমনে করতে হয়। এর লগে গলা মিলায়া, এলিজাবেথ এডওয়ার্ড আরও দুরন্ত সম্ভাবনা সাব্যস্ত করছেন, তার ভাষায় ‘ইতিহাসের কাচা রসদ’ কুড়ায়া আনতে ক্যামেরার বিকল্প হয় না।
এই আশ্বাস এত উচ্ছ্বাস ছড়ায়, দৃষ্টিভেদ কইরা গহীনের গোপন ‘সত্য’ আবিষ্কারের মোহ বাড়ায়া তোলে, চর্ম চক্ষে এতদিনকার অদেখাকে জয় কইরা আনার রোমাঞ্চে অনেকেই ক্যামেরার দিকে হাত বাড়াইতে শুরু করে। দ্য ক্যালকাটা কুরিয়ার ১৮৪০ এর ৫ই মার্চ ভারতের প্রথম দাগুয়েখ টাইপের বিস্ময় নিয়া একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এশিয়াটিক সোসাইটির একটা সভায় এসপ্ল্যানেড এবং কলকাতার আরও কিছু এলাকার কয়েকটা ফটোগ্রাফ দেইখা তো লোকের চক্ষু ছানাবড়া! পরের দিন দি ইংলিশম্যান এন্ড মিলিটারি ক্রনিকল-এর প্রতিবেদনে তো উচ্ছ্বাস যেন আর ধরে না। উল্লেখ করে যে, চৌরঙির একটা ঘর থেইকা তোলা কয়েকটা ছবি খালি চোখে তো নজর কাড়েই, সাথে মাইক্রোস্কোপ দিয়া দেখলে টের পাওন যায় ছবিগুলাতে এমন কিছুর ছাপ ধরা পড়ছে যা এমনি সাধারণ চোখে কোনভাবেই উদ্ধার করা সম্ভব হইত না। বম্বের ফটোগ্রাফিক সোসাইটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (১৮৫৪, ৩ই অক্টোবর) সভাপতির ভাষণে ক্যাপ্টেন হ্যারি বার বলেন, ‘বলার অপেক্ষা রাখেনা… ইন্ডিয়া ফটোগ্রাফারদের জন্য একটা বিশাল ক্ষেত্র মেইলা ধরছে… আমাদের এমন এক শিল্প চর্চায় উদ্দীপ্ত হওন উচিত যা শিব এবং সুন্দর ছাপায়া সত্যের জয়গান হইবে’। সত্য-বস্তুর সন্ধানে এই সংঘের যাত্রাকালে তের সদস্যের মাঝে তিনজন ভারতীয়ও নাম লেখান। যার মধ্যে একজন ডাক্তার বাহু দাজি, ইনি আমাদের আলোচ্য নারায়ণ দাজির বড় দাদা।
যাত্রার পরের বছর, ১৮৫৫ সংঘের একটা সাধারণ সভায়, নারায়ণ দাজির বেশ কয়েকটা আলোকচিত্র হাজেরানে মজলিশের সামনে প্রদর্শিত হয়। তারা বেশ মুগ্ধ হন, দাজির কাজের প্রশংসা করেন। পরে সংঘের জার্নাল উল্লেখ করে বলে যে, ‘এতে বুঝা যায় দেশীয়দের হাতও বেশ পাকাপোক্ত হইছে এবং নতুন এই শিল্পের চর্চায় বেশ উন্নতি সাধন করছে’। এতে বারটার মত ছবি ছিল। তুলনায় বলা যায়, দাজি ইউলিয়ম জনসন বা বেঞ্জামিন সিম্পসনদের চে’ দক্ষতা প্রদর্শনে কোন অংশে কম যান নাই। উনিশ শতকের মধ্যভাগে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল ঘুইরা এগুলা তোলা। এখানে তরুণ নারায়ণ দাজির আধুনিক চোখে ভারতের প্রায় নিশ্চল গ্রাম, অনড় রীতিনীতি আর বিস্তীর্ণ প্রকৃতির মাঝে মানুষের উপস্থিতি পেশা ও বৃত্তির অনুষঙ্গ হইয়া উঠছে। মানুষগুলাকে তার পেশা, পোশাক, সরঞ্জাম ও শরীরের গড়ন থেকে আলাদা কইরা ঠাহর করা প্রায় কষ্টকর ঠেকে। এরা যেন বিভিন্ন অংশে, উপকরণের উপাত্ত হিশাবে অনেক যতœ সহকারে, মেপে মেপে, বাহুল্য ছাড়িয়ে পরিচ্ছন্ন প্রামাণ্য সংগ্রহে সতর্ক আয়োজনে কেটে আনা অংশবিশেষ। তাদের বসার ভঙ্গি কিম্বা দাঁড়ানো, হাত ও পায়ের অবস্থান এমনভাবে সাজানো, হাতিয়ারগুলা এমনভাবে গুঁজে দেয়া, মনে হইতে পারে বুঝি এগুলা ধইরা থাকার জন্যই তাদের ডাক পড়ছে। তারা বেশ শক্ত, ভাবলেশহীন-ভাবে নিজের শরীর যথাসম্ভব যন্ত্রানুসঙ্গের অনুকূলে জড়সড় কইরা রাখছে। হাত পা একটু নড়াচড়া করলে বা শরীর এদিক সেদিক একটু হেলে পড়লে হাতে ধরা বস্তুগুলার জ্যামিতিক ফর্ম, শৃঙ্খলা হুড়মুড় ভাইঙ্গা পড়তে পারে, সেই ভয় যেন তাগোরে তাড়া করতেছে।