ভাল্টার বেনিয়ামিন
অনুবাদ: মুসতাইন জহির
…শিল্প নবিশীর অভিজ্ঞতার জন্য নয় বরং নতুন কায়দা রপ্তকরণে সিদ্ধহস্ত হবার উপরেই আলোকচিত্রে তাদের যাবতীয় মুনশিয়ানা দিতে হয়। ক্রমে এই মধ্যম প্রজন্ম কালের অতলে মিলায়া যায়। মনে হয় যেন আদিপুস্তক বাইবেল কথিত বিশেষ কৃপাধন্য হইয়া নাদার, স্টেলজনার, পিয়ারসন, বেয়ার্ড প্রভৃতি সবাই বয়সের কোটা আশি কি নব্বই ছুঁইতে পারছে। যদিও শেষতক, সবদিকের লোকেরা পেশাদারি আলোকচিত্রের ব্যবসায় ঢুইকা পড়ে। যখন নেগেটিভ বাড়তি ঘষামাজা কইরা ছবি বাইর করার ধুম লাগে, তখন বাজে চিত্রকরদের পোয়াবারো হয় আলোকচিত্রের উপর প্রতিশোধ নেয়ার। চটজলদি উনা রুচি দশদিক দখল করতে থাকে। এসময়ই আলোকচিত্রের এ্যালবামের চল শুরু হয়। বাসাবাড়ির ঠাণ্ডা জায়গায়, সাজানো টেবিলে, বসবার ঘরে তখন ছবির এ্যালবাম দৃষ্টিগ্রাহ্য কইরা রাখা হইত। চামড়া দিয়া বাঁধাই করা চকচকে ধাতব পাতের ফ্রেমে: অ্যালেক্স চাচা কিম্বা রিখি খালা, ট্রুডি যখন পিচ্চি ছিল, বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছর, ইত্যাকার ছবিতে ভইরা থাকত। শেষমেশ নিজের দুষ্টামিভরা কিছু দৃশ্য না থাকলে ওটা যেন সম্পূর্ণ হইত না। এই যেমন: নরসুন্দরের মত চুল কাটার অঙ্গভঙ্গি, হাত-পা নাইড়া হেড়ে গলায় গান, আগুনের ফুলকি আঁকা কোন ছবির কাছে আগুন নেভানোর ভঙ্গিতে হ্যাট নাড়ানো, ভারিক্কি চালে নাবিক সুলভ কেতা, কিম্বা এক পায়ে ঠেস দিয়া খাড়ানোর বিশেষ কোনো ভঙ্গিমা।
এইসব পোট্রেট-এ কোন খুটিঁ বা স্তম্ভ কিংবা ডিম্বাকৃতির টেবিল জাতীয় উপকরণাদি ব্যবহার করা হইত যাতে ঠেস দেয়া যায়। ওটা এক্সপোজারকালীন লম্বা সময়টাতে মডেলের সটান রাখার দরকারের কথাই মনে করাবে। মাথা কিংবা হাঁটু সোজা রাখতে ব্যবহৃত উপকরণাদি পয়লা পয়লা যথেষ্ট মনে হইলেও পরে তা বিখ্যাত চিত্রকলার অনুকরণে ফ্রেমে আরো সব শৈল্পিক উপাদান যুক্ত করে মানুষজনের চাহিদা তৃপ্ত করার পথ ধরে। এরই হাত ধইরা আসে কলাম এবং পর্দা। অবশ্য সমঝদাররা সেই ষাটের দশকেই তাতে আপত্তি তোলে। পেশাদার এক ইংরাজি জার্নালে প্রশ্ন তোলা হয়: ‘চিত্রকলার মধ্যে কলাম না হয় বুঝা গেল, কিন্তু আলোকচিত্রে যেভাবে এটা ঢুকানো হইছে তাতে তো কিম্ভূতকিমাকার ধারণ করছে। সাধারণত দেখা যায় মডেল কার্পেটের উপরই দণ্ডায়মান। তো, মার্বেল বা পাথরের কলাম কার্পেটের উপর ভিত গাইড়া মাথা তুইলা আছে এটা কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব?’ এটা ছিল সেইসব স্টুডিওর জমানা যেখানে ঝালর শোভিত পাম গাছ, কারুকাজময় সজ্জা এবং ক্যানভাস ঝুলিয়ে রাখার ফ্রেম ইত্যাকার নানাবিধ উপকরণে ভর্তি কক্ষটা যেন ছবির উপস্থাপন বা ফাঁসির বেদি, নির্যাতন কক্ষ বা রাজাসনের মত দ্বিবিধ চরিত্র নিয়া দ্বিধাগ্রস্ত হ’য়া থাকত। কাফকার প্রথমদিকার একটা পোট্রেট যার সরস নজির হ’য়া আছে। সম্ভবত বছর ছয়েকের একটা বাচ্চা, খুবই আটোসাটো বিব্রতকর একটা স্যুট পরে শীতকালের কোনো বাগানে দাঁড়ায়া আছে। পিছনে পামগাছের পাতাগুলা যেন ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে আছে। যেন ঐসব আদ্দিকালের রদ্দিমার্কা জিনিসে ঠাসা পরিবেশটাকে আরো গুমোট করে তুলতে বেমানান একটা বড়সড় হ্যাট (এ ধরনের হ্যাট স্প্যানিশরা পরে) বাম হাতে নিয়া খাড়ায়া আছে। আমরা আশপাশের এতসব কিছুর ভিতরেই হারায়া যাইতাম যদি না তার নিঃসীম বিমর্ষ চোখগুলা আর সব ছাপায়ে জায়গা কইরা নিবার প্রাণপণ আকুতিতে ভর্তি না থাকত।
অসীম বেদনার ভেলায় ভাসানো ছবিটা পয়লা জমানার সব আলোকচিত্রের প্রতিমূর্তি বনছে মনে লয়…