সোশাল রিয়ালিটির বাস্তবতা অভিযান

কলোনিয়াল পোর্ট্রেট থেকে ডেভেলপমেন্ট ডিসকোর্স

নাঈম মোহায়মেন

…পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফিতে বাস্তবতার আগমনের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গেলে পেইন্টারদের প্রসঙ্গটা চলে আসে, বিশেষ করে জয়নুল এবং পরবর্তীতে কামরুলের ভূমিকা। এখানে কলোনিয়াল আমলের ফটোগ্রাফারদের লিগাসি নিয়ে বিড়ম্বনাটা আরেকটু তীক্ষ্ণ হয়। দেশ-বিভাগের আগে যে ফটোগ্রাফির ধারা চালু ছিল তা যথেষ্ট ভাবে এই বাংলার ফটোগ্রাফিকে রিয়ালিজমের দিকে টেনে নিতে পারেনি (যদিও কিছু ফটোগ্রাফি স্টুডিও স্থাপন হয়েছিল)। এবং এই শূন্যতার কারণেই জয়নুলের কাজের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জয়নুলের ভূমিকার কথা বলতে গেলে মন্বন্তরের কাজটি (‘ফ্যামিন সিরিজ’) ভালমতো বুঝতে হবে, এবং বিশেষত সেই সময়কার প্রচলিত চারুকলায় এর প্রভাবটাকে খতিয়ে দেখতে হবে। সেই সময়ের প্রচলিত ধারার ব্যাপারে শোভন সোম লিখেছেন:
‘অ্যাকাডেমিক কেতার পুরোধা শিল্পীদের ছবিতে বিষয় হিসাবে প্রাধান্য পেত নগ্নিœকা, অভিজাত বা ধনবান মানুষের অজুরায় আঁকা প্রতিকৃতি এবং অজুরায় আঁকা নানা বিষয়ের ছবি। বলা বাহুল্য, যেহেতু ছবি আঁকাই তাঁদের জীবিকার উপায় ছিল এবং সে সময় মুষ্টিমেয় ক্রেতাদের মধ্যে ছিলেন দেশীয় রাজন্যবর্গ, জমিদার, উচ্চপদস্থ রাজপুরুষ বা বণিক এবং এই ক্রেতাদের রুচি-মাফিক না আঁকলে জীবিকার সুরাহা সম্ভব ছিল না, এ কারণে এই শিল্পীদের পক্ষেও নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে পা ফেলা কঠিন ছিল। ঐ সব বিষয় ছাড়াও এঁরা এক ধরনের দৃশ্য-চিত্র আঁকতেন যা ছিল রোম্যান্টিক আবেগে আপ্লুত, যেমন ঘনায়মান সন্ধ্যায় প্রান্তরে নামাজি, বনান্তরালে পল্লীবধূ, গোচারণ শেষে গো-পালসহ রাখাল-বালক ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, বাস্তবতা-বর্জিত এই সব রোম্যান্টিক ছবির লক্ষ্য ছিল এক বিশেষ ধরনের ক্রেতা।’৪

এই প্রেক্ষিতটা লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, সেই সময়কার শিল্পীরা বাইরের পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবকে নিজেদের কাজে জায়গা দিত না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে, কলকাতায় বিদেশি সৈন্যের আনাগোনা, গ্রামে- গ্রামে ক্ষুধার্ত মানুষ না খেয়ে মরছে। অথচ এই পরিস্থিতিতে যামিনী রায় আঁকছে যিশু ও কৃষ্ণলীলার ছবি, যার খদ্দের কলকাতার উচ্চবিত্ত মানুষ অথবা আগন্তুক মার্কিন ও ইংরেজ সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসার। একই সময়ে ক্যালকাটা গ্র“প বিশ্ব রাজনীতির ব্যাপারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ না নিয়ে বরং দলীয় কর্মী-শিল্পী চিত্তপ্রসাদ, সূর্য রায়, রথীন মৈত্র ও সোমনাথ হোরকে পোস্টার আঁকার কাজে আটকে রেখেছেন। এমনকি নীরদ মজুমদারকে কৃষক সম্মেলনের মঞ্চ তৈরির কাজে ব্যস্ত রাখা হয়।
এই নির্লিপ্ত শিল্প পরিস্থিতিতে জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবি কলকাতার ভদ্রলোক সমাজে একটা হাতবোমার মত বিস্ফোরিত হয়। শোভন সোমের ভাষায়ঃ
‘জয়নুলের ছবিতেও আমরা প্রতিবাদ দেখি না; যে সমাজব্যবস্থা এই দুর্ভিক্ষ তৈরি করেছে, তার বিরুদ্ধে একটাও উত্তোলিত তর্জনী নেই। তার বিপ্রতীপে আছে নীরবে নিয়তিকে মেনে নেওয়া, আছে প্রতিবাদ-হীন মৃত্যু, কিন্তু প্রশ্ন নেই। তাঁর ছবির সামনে দাঁড়ালে দর্শক ভাবতে বাধ্য হন, কেন বিনা প্রশ্নে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ এই পরিণাম মেনে নিল। আমরা দর্শক হিসাবে ভাবতে বাধ্য হই, যুগ যুগ ধরে এই দেশ কেন এইভাবে ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। আর তখনই আমরা তাঁর ছবিতে নিজেদের স্বরূপ দেখে অনুভব করি যে, এই সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। তাঁর ছবিতে যা প্রতিবাদ-হীনতা বলে প্রতিভাত হয় বস্তুত তা প্রতিবাদকেই উসকে দেয়।’৫
জয়নুলের দুর্ভিক্ষ সিরিজের রূঢ়, মোটা, উগ্র, ড্রাই ব্রাশ স্ট্রোকগুলো নতুন এক ভাষার ইঙ্গিত দেয়। আলোচকরা বলেন যে, এই কাজের মধ্যে উঁচিয়ে ধরা মুঠিটা নেই। কিন্তু রাগ আছে প্রচুর। ভিক্ষুক, কুকুর, কাক এক জায়গায় মিলে গেছে ছবিগুলোতে। তাদের খাদ্য সন্ধানের স্থান এবং মৃত্যুর জায়গা মিলেমিশে আছে। হয়ত এক প্রজাতি মরলে সে অন্যের খাবারে পরিণত হবে। কলকাতার শিল্প-মহল জয়নুলের কাজ দেখে হতবাক হয় শুধু সোশাল রিয়ালিজমের থাপ্পড়ের জন্য নয়। তার সাথে যুক্ত হয় এই চিন্তাঃ ‘এ কোথা থেকে এলো, আমাদের প্রভাবের চিহ্ন পাচ্ছি না কেন?’ অনেকে তাকে বাক্সবন্দি করার জন্য ‘সোশাল রিয়ালিস্ট মুসলিম’ বলে আখ্যায়িত করে।
জয়নুলের সেই বড় ভাঙনের পর ফিরে যাবার পথ আর থাকে না। তার অনুগত কামরুল হাসান ও সফিউদ্দিনের কাজের সমন্বয়ে পেইন্টিংয়ের রোমান্টিক অতীতের সাথে একটা ভাঙন হয়ে যায়। ভারত বিভাগের পরে জয়নুলের প্রভাবে রিয়ালিজম পূর্ব পাকিস্তানের পেইন্টিংয়ে ঢুকে যায়। আমার ধারণা, এই জয়নুল স্কুল থেকেই রিয়ালিজমের ধারাটা ফটোগ্রাফির মধ্যে চলে আসে (বা, অনেকগুলো প্রভাবের একটা)। যেহেতু পূর্ববঙ্গের আলোকচিত্রে কলোনিয়াল বেঙ্গল ধারাটা দেশবিভাগের কারণে হারিয়ে যায়, ৫০ ও ৬০ দশকের ফটোগ্রাফি সেই কলোনিয়াল ধারাকে উপেক্ষা করে বরং চারুকলার জয়নুল ও অন্যান্যের প্রভাব গ্রহণ করে। পরের দশকের ফটোগ্রাফিতে বাস্তবতার উপস্থাপন জয়নুলের সেই ‘ফ্যামিন’ সিরিজের পরবর্তী ধাপ হিশাবে ভাবা যায়। যাত্রাপথে কোন এক সময়ে জয়নুলের এগ টেম্পেরা হয়ে যায় নাইব উদ্দিনের নেগেটিভ।

 

আদম সুরত: নমুনা ও নারায়ণ দাজি

মুসতাইন জহির

…হারাধন দে-র পূর্বসূরি, স্বজাতির মধ্যে ডাক্তার নারায়ণ দাজি (১৮২৮-১৮৭৫) যখন ক্যামেরা হাতে বের হন, তখন তিনিও এক প্রকার কর্তব্য কাজেই শরিক হন। তবে সে কর্তব্য তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের তরে খেটেছে অনেকটা! বিজাতির মধ্যে ইউলিয়ম জনসন আর বেনিয়ামিন সিম্পসনও এইকাজে ভূ-ভারতের ‘আদম’ সুরতের নমুনা সংগ্রহে নামেন সেই সময়। নমুনা সংগ্রহের এই প্রকল্প-কলোনির জ্ঞান ও বিজ্ঞান প্রযোজনা, প্রশাসন পরিচালনা এবং পরিসংখ্যান সাজানোর বর্ণবাদী ভাবধারার উদ্দেশ্য ও বিধেয়’র অন্তর্ভুক্ত। কলোনির লগে এথনোগ্রাফি চর্চার কায়কারবারে ফটোগ্রাফি কি যোগান দিতে আসে, সেই আলাপে যাওনের আগে নারায়ণ দাজির দলভুক্ত হওনের বিষয়টা একটু বইলা নেয়া যাইতে পারে। দাজি বম্বে মেডিকেল কলেজ থন পাশ কইরা বাইর হন ১৮৫২ সনে, তখনও ফটোগ্রাফি জিনিসটা হাঁটি হাঁটি পা পা, উদ্ভাবিত হইছে মাত্র তের বছর। এরই ভিতরে ১৮৫৪ সনে বম্বে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি আর তার দুই বছর পরে কলকাতা এবং মাদ্রাজে অর্থাৎ ১৮৫৬ সনে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি খাড়ায়া যায়। দাজি এলফিনস্টোন কলেজে ফটোগ্রাফিতে মাস্টারির সুযোগটা অল্পের জন্য হাত ছাড়া করেন। বম্বে ফটোগ্রাফিক সোসাইটির কাউন্সিল মেম্বার থাকেন, ১৮৫৭-৬১ পর্যন্ত। ভারতীয় আদম সন্তান (পিপল অব ইন্ডিয়া, ১৮৬৮-৭৫) নামে আট খণ্ডে যে বই বাইর হয় তার প্রথম খণ্ডে তার কাজ ছাপা হয়।

ভারতের ইতিহাসে ১৮৫৭ ইসায়ী’র সিপাহি বিদ্রোহ বা প্রথম ‘জাতীয় যুদ্ধ’ খ্যাত ইংরাজ বিরোধী সশস্ত্র পন্থা সরকার সামলে নিলে পরে, পুরাতন কায়দায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ক্ষমতা রাইখা উপনিবেশের এই ভাগটা শাসন-কর্তৃত্বে আর ধইরা রাখন যাইব না, সেই বিষয়ে রানীর সরকার নিশ্চিত হয়। শাসন-তান্ত্রিক কাঠামো আর প্রশাসনিক বিন্যাসে হাত লাগানোর ব্যাপারে তারা মনস্থ করে। এই ভাবনার প্রায়োগিক বন্দোবস্তে, বড় একটা দিক এন্তেজাম দিতে দরকার পড়ে সেনসাস বা আদমশুমারির। মাথা গোনার পাশাপাশি, কার মাথা কিভাবে কোন বর্গে ভাগ করবেন, বাটোয়ারায় কার লগে কারে মিলায়া কি পরিচয় দিবেন, কার মুখ কোনদিকে ঘুরাইবেন, সেই কাজে আরও জোরদার ভাবে বিশাল ভারতের কোনা-কাঞ্চি পর্যন্ত আদম সন্তানদের সম্প্রদায় গত আচার অভ্যাস, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ধার্য করণের কর্মযজ্ঞে ডাক পড়ে ফটোগ্রাফারদের। কারণ, উদ্ভাবনের পর থেইকা এই বিশ্বাসের জয়জয়কার হইতে থাকে যে, ক্যামেরাই একমাত্র জাদুযন্ত্র যা অবিকল, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশেষত্ব সহ প্রতিটা বিষয়ের আগাপাছতলা হুবহু গ্রেফতার করতে সক্ষম। বিবরণ এতই নিখাদ, নির্ভরযোগ্য ও চোখের অধিক বাস্তবতার (আটার ট্রুথ) তালাশ দিতে পারে, যাতে যাবতীয় সংশয় অমূলক হইয়া যায়। ফটোগ্রাফারের নিজের ইচ্ছা নিরপেক্ষ নিশ্চিত, নৈর্ব্যক্তিক রেকর্ড পাওয়া যায়। ক্যামেরা ফটোগ্রাফারের চোখ দিয়া দেখেনা, মানে ফটোগ্রাফার যা দেখেনা ক্যামেরার কাচ তাও দেখে এবং চোখ যা বাদ দিতে চায় ক্যামেরা তারেও টাইনা আনে। এই ক্ষমতা, মানুষের ইচ্ছার বাইরে গিয়া বাইরের দুনিয়া ধারণ করবার যে কেরামতি তারে মারগারেট ইভারসেন নাম দিছেন ক্যামেরার ‘জন্মান্ধ চোখ’। যে জানেনা সেন্সর কেমনে করতে হয়। এর লগে গলা মিলায়া, এলিজাবেথ এডওয়ার্ড আরও দুরন্ত সম্ভাবনা সাব্যস্ত করছেন, তার ভাষায় ‘ইতিহাসের কাচা রসদ’ কুড়ায়া আনতে ক্যামেরার বিকল্প হয় না।

এই আশ্বাস এত উচ্ছ্বাস ছড়ায়, দৃষ্টিভেদ কইরা গহীনের গোপন ‘সত্য’ আবিষ্কারের মোহ বাড়ায়া তোলে, চর্ম চক্ষে এতদিনকার অদেখাকে জয় কইরা আনার রোমাঞ্চে অনেকেই ক্যামেরার দিকে হাত বাড়াইতে শুরু করে। দ্য ক্যালকাটা কুরিয়ার ১৮৪০ এর ৫ই মার্চ ভারতের প্রথম দাগুয়েখ টাইপের বিস্ময় নিয়া একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এশিয়াটিক সোসাইটির একটা সভায় এসপ্ল্যানেড এবং কলকাতার আরও কিছু এলাকার কয়েকটা ফটোগ্রাফ দেইখা তো লোকের চক্ষু ছানাবড়া! পরের দিন দি ইংলিশম্যান এন্ড মিলিটারি ক্রনিকল-এর প্রতিবেদনে তো উচ্ছ্বাস যেন আর ধরে না। উল্লেখ করে যে, চৌরঙির একটা ঘর থেইকা তোলা কয়েকটা ছবি খালি চোখে তো নজর কাড়েই, সাথে মাইক্রোস্কোপ দিয়া দেখলে টের পাওন যায় ছবিগুলাতে এমন কিছুর ছাপ ধরা পড়ছে যা এমনি সাধারণ চোখে কোনভাবেই উদ্ধার করা সম্ভব হইত না। বম্বের ফটোগ্রাফিক সোসাইটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (১৮৫৪, ৩ই অক্টোবর) সভাপতির ভাষণে ক্যাপ্টেন হ্যারি বার বলেন, ‘বলার অপেক্ষা রাখেনা… ইন্ডিয়া ফটোগ্রাফারদের জন্য একটা বিশাল ক্ষেত্র মেইলা ধরছে… আমাদের এমন এক শিল্প চর্চায় উদ্দীপ্ত হওন উচিত যা শিব এবং সুন্দর ছাপায়া সত্যের জয়গান হইবে’। সত্য-বস্তুর সন্ধানে এই সংঘের যাত্রাকালে তের সদস্যের মাঝে তিনজন ভারতীয়ও নাম লেখান। যার মধ্যে একজন ডাক্তার বাহু দাজি, ইনি আমাদের আলোচ্য নারায়ণ দাজির বড় দাদা।

যাত্রার পরের বছর, ১৮৫৫ সংঘের একটা সাধারণ সভায়, নারায়ণ দাজির বেশ কয়েকটা আলোকচিত্র হাজেরানে মজলিশের সামনে প্রদর্শিত হয়। তারা বেশ মুগ্ধ হন, দাজির কাজের প্রশংসা করেন। পরে সংঘের জার্নাল উল্লেখ করে বলে যে, ‘এতে বুঝা যায় দেশীয়দের হাতও বেশ পাকাপোক্ত হইছে এবং নতুন এই শিল্পের চর্চায় বেশ উন্নতি সাধন করছে’। এতে বারটার মত ছবি ছিল। তুলনায় বলা যায়, দাজি ইউলিয়ম জনসন বা বেঞ্জামিন সিম্পসনদের চে’ দক্ষতা প্রদর্শনে কোন অংশে কম যান নাই। উনিশ শতকের মধ্যভাগে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল ঘুইরা এগুলা তোলা। এখানে তরুণ নারায়ণ দাজির আধুনিক চোখে ভারতের প্রায় নিশ্চল গ্রাম, অনড় রীতিনীতি আর বিস্তীর্ণ প্রকৃতির মাঝে মানুষের উপস্থিতি পেশা ও বৃত্তির অনুষঙ্গ হইয়া উঠছে। মানুষগুলাকে তার পেশা, পোশাক, সরঞ্জাম ও শরীরের গড়ন থেকে আলাদা কইরা ঠাহর করা প্রায় কষ্টকর ঠেকে। এরা যেন বিভিন্ন অংশে, উপকরণের উপাত্ত হিশাবে অনেক যতœ সহকারে, মেপে মেপে, বাহুল্য ছাড়িয়ে পরিচ্ছন্ন প্রামাণ্য সংগ্রহে সতর্ক আয়োজনে কেটে আনা অংশবিশেষ। তাদের বসার ভঙ্গি কিম্বা দাঁড়ানো, হাত ও পায়ের অবস্থান এমনভাবে সাজানো, হাতিয়ারগুলা এমনভাবে গুঁজে দেয়া, মনে হইতে পারে বুঝি এগুলা ধইরা থাকার জন্যই তাদের ডাক পড়ছে। তারা বেশ শক্ত, ভাবলেশহীন-ভাবে নিজের শরীর যথাসম্ভব যন্ত্রানুসঙ্গের অনুকূলে জড়সড় কইরা রাখছে। হাত পা একটু নড়াচড়া করলে বা শরীর এদিক সেদিক একটু হেলে পড়লে হাতে ধরা বস্তুগুলার জ্যামিতিক ফর্ম, শৃঙ্খলা হুড়মুড় ভাইঙ্গা পড়তে পারে, সেই ভয় যেন তাগোরে তাড়া করতেছে।

 

স্মিথস্ক্রিয়া

তানজিম ওয়াহাব

সাইপেন দ্বীপ, আমেরিকার লাগামহীন বোমায় নাস্তা বুদ জাপানিরা। তাদের কেউ কেউ পরিবার নিয়ে গুহায় লুকিয়ে ছিল। আমেরিকানদের বোমাগুলো যেন পথ খুঁজে খুঁজে গুহাতে গিয়েই পড়ে, আর গুহা থেকে ক্রমাগত লাশ বেরিয়ে আসে। দু একজন জ্যান্ত মানুষ চোখে মৃত্যু ভয় নিয়ে ছুটতে থাকে, ছোট ছোট বাচ্চা, মা, দাদি। আমেরিকারই একজন ফটোগ্রাফার ছবিগুলো তুলতে থাকে। নিজের দেশের এই নির্বিচারে হত্যা তাকে ভয়াবহ পীড়া দেয়। কিন্তু সেতো দোটানায় পড়ে গেল। একদিক থেকে এই ছবিগুলো সেই জায়গায় তোলাটা ফটোগ্রাফার হিশাবে তার দায়িত্ব মনে হয়, আবার আরেকদিকে যুদ্ধের এই আশাহীন, নিস্তেজ ছবিগুলো তোলাটাও অর্থহীন মনে হয়। ছবি তুলতে গিয়ে এমন দ্বিধা ইউজিন স্মিথের জীবনে বারবার আসে, সমাধানও সবসময় মেলে না। কিন্তু ইউজিন ছবিটা তুলে যায়, আর ছবিগুলো বদলাতে থাকে।

সময়টা বোঝার চেষ্টা করেন। ইউজিন যখন তরুণ টগবগে যুবক, পৃথিবী তখন অনেক গরম হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দাঙ্গা, রক্ত, নির্বিচারে হত্যা। সে বারের যুদ্ধে ইউজিন নিজেও প্রচণ্ড আহত হয়, আর এরপর টানা দুই বছর বিছানায় পড়ে থাকে। বিছানার দিনগুলোতে ইউজিন জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক করে যুদ্ধের আর কোন ছবি তুলবে না। হয়ত যুদ্ধের বিপরীত কোন ছবি তোলা দরকার, যেই ছবি দেখলে বাঁচতে ইচ্ছা করবে। তাই দুবছর পর প্রথম ছবিটা তুলে নিজের ছেলে-মেয়ের, বাড়ির সামনের বাগানে। বাচ্চাগুলো তুলতুলে হাত দুটো ধরে কোন এক আলোর পথে যাচ্ছে, আলোটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেটে বের হচ্ছে, গন্তব্যটা অজানার, কিন্তু অনেক স্বপ্নের। ছবিটার নাম ওয়াক টু পেরাডাইস গার্ডেন।

ইউজিনরা বলতে চাইত জীবন ঘেঁষা গল্প, মানুষ ঘেঁষা গল্প। সংগ্রাম বা সবকিছু সামলে উঠার সাহস সঞ্চারী গল্প। তার ছবি জুড়ে অনেক কালো আর কন্ট্রাস্ট। তার ছবিতে একদিকে শোষিত, জীবন যুদ্ধে নুয়ে পড়া মানুষের দল, আর অপর দিকে না দেখা সব নায়কের এই যুদ্ধটা লড়ে যাওয়ার কাহিনী।

পেঁচালের ফাঁকে সুমনের একটা গান শুনাই। গিটারের অলস, মৃদু, টুং টাং আওয়াজ আর ভারি গলাটায় ছড়া কাটা কাটা সুর…
‘বাচ্চারা কেউ ঝামেলা করোনা উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করোনা
চুপচাপ বসে থাক, বসে আঁক, বসে আঁক
আঁক ফুল নদী, আর প্রজাপতি, আঁক মিকি মাউস অগতির গতি
আঁক কুঁড়েঘর যদিও তোমরা পাকা বাড়িতেই থাক
এঁকো না কখনও স্বদেশের মুখ, দবড়ানো গাল ভেঙ্গে যাওয়া বুক
মর মর তার পরাণ ভোমরা…’

ঝামেলা করতে নিষেধ করা হল, অথচ ইউজিন ঝামেলা করবেই, উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করবে, হয়ত সে চুপচাপ বসে থাকতে চায়নি। বদরাগী, ঝগড়াটে এই লোক নিজের শর্তে আপসহীন, জেদি। তার সাথে কাজ করা যে কারও জন্যই কঠিন ছিল। কোন কিছু ঠিক না মনে হলে ইউজিন কথা শোনাবে, পরিমিত থাকার প্রশ্নই ওঠে না, ঝগড়া হয়ত বাঁধবে, এরপর মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতসব শর্ত আর দেমাগ দেখানোর পরও মানুষ ইউজিনকে বাদ দিতে পারে নাই, তার কাজকে গ্রহণ করতে হয়েছে। দাঁড়ান, কারণগুলো আস্তে আস্তে বয়ান করার চেষ্টা করি। তার ছোটবেলা আর দশজনের মত খুব সুন্দর, সাজানো, গোছানো ছিল না। ইউজিন এর জন্ম ১৯১৮ সালে আমেরিকার কানসাসে। বাবা ছিল ছোটখাটো গমের ব্যবসায়ী, ব্যবসাতে লোকসান করে কোন এক সকালে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করে সে। ইউজিন ভীষণ চমকে যায়, ব্যথা সারিয়ে উঠতে অনেকদিন সময় লাগে। ভাইয়ের পোলিও ছিল, সংসারে অভাব ছিল। কিন্তু ইউজিনের মা ছিল বেশ শক্ত, বদরাগী আর আত্মবিশ্বাসী মহিলা। মা একাই তাকে মানুষ করে। ইউজিন অনেকটাই ছিল মা ঘেঁষা, মায়ের কথার অবাধ্য হওয়ার সাহস তখনও হয়ে উঠেনি।

সেই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পর ইউজিন মাতে ছবির গল্পে, ছবি যেন উছিলা, আসলে ছবি দিয়ে জীবনের গল্পে পৌঁছনোর চেষ্টা। ফটো স্টোরি কিম্বা নেরেটিভ ফটোগ্রাফি নামের এক নয়া জিনিসের চল তৈরি করে। আগের মত কোন একটা ফটোতেই নন্দন চর্চা না, বরং অনেকগুলো ছবি গেঁথে গল্প বয়ান করা। সেখানে প্রতিটা ছবিরই হয়ত নিজস্ব শক্ত বুনন থাকে, কিন্তু ছবিগুলো মিলে কোরাস এর মত একসাথে কাজ করে, দলে দলে গান গায়। একই সময়ের আগে পরে জেকব রিস, এডওয়ার্ড কার্টিস, লুইস হাইনরা একই বিষয়ের অনেকগুলো ছবি তুলছে, কিন্তু গল্পের শুরু আর শেষটা ভেবে ইউজিনের মত এত গুছিয়ে ছবিতে গল্প তখনও আসেনি…

বেসার-মঙ্গল

আরফান আহমেদ

ছবিগুলো দেখতে কেমন জানি। কোন কিছুই নাই ছবিগুলোতে। না আছে কোন মানুষ, না আছে কোন সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। আছে খালি বড় বড় শিল্প স্থাপনা, যেমন ব্লাস্ট ফার্নেস, ওয়াটার টাওয়ার, কুলিং টাওয়ার, গ্যাস টাওয়ার, উইন্ডিং টাওয়ার, কয়লা খনির স্থাপনা এই রকম বিদঘুটে আরও অনেক কিছু। আর কম্পোজিশন! তার তো কোন বালাই নাই। এইসব বড় বড় বিদঘুটে জিনিস ছবির একদম মাঝখানে। রুল অব থার্ড বলে যে কলা জগতে কোন কিছু বিদ্যমান আছে তা এই ছবিগুলো দেখলে বোঝা মুশকিল। আর আলো ছায়ার খেলা সে তো দূর-স্থান! সাদা কালো এই ছবিগুলোর কনট্রাস্টের কথা আর নাইবা বলি। এই রকম প্রাণহীন, মরা, গতিহীন, ব্যানাল ছবি তোলেন বের্ন্ড এবং হিলা বেসার।

সময়টা গত শতকের ষাটের দশক। প্রবল উন্মাদনায় ভরা একটা দশক। সময়ের এই উন্মাদনা এসে ধাক্কা দেয় আলোকচিত্রের দুনিয়াতেও। পুরনোকে একেবারে দুমড়ে মুচড়ে ফালি ফালি করে ছুঁড়ে ফেলেন এই প্রজন্মের আলোকচিত্রীরা। কার্তিয়ে ব্রেসো গংদের সাম্রাজ্যের উপরে নেমে আসে একের পর এক আঘাত। দার্শনিক এবং নন্দন-তাত্ত্বিক আঘাত। রবার্ট ফ্রাঙ্ক, তার গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন মার্কিন দেশের পুব থেকে পশ্চিম। তার ছবি হয়ে উঠল ইতিহাস, বিদ্রোহী আলোকচিত্রীদের ইশতেহার, ব্রেসোর নির্ধারণই [উত্তুঙ্গ] মুহূর্তের একচেটিয়া দাপটের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ। উইলিয়াম ক্লেইন তার ৩৫ এম.এম. লেইকা ক্যামেরা আর ওয়াইড এঙ্গেল লেন্স নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নিউ ইয়র্কের উত্তাল রাস্তায়, প্রবল আগ্রাসী ভঙ্গী, আর বিষয়বস্তুর সাথে তার এমন উন্মত্ত বোঝাপড়া তাকে বানিয়ে তুলল যুগের প্রধান পপ ফটোগ্রাফার। আর গ্যারী উইনোর্গ্যান ছবি তুললেন ছবিতে দুনিয়া কেমন দেখায় তা দেখার জন্য, ঘোষণা করলেন আলোকচিত্র তার প্রাণের ক্ষুধা মেটায়। ডিয়ান আর্বুয সমাজের প্রান্তিক মানুষদের পোর্ট্রইেট তুললেন, তুললেন সমাজ কর্তৃক ঘোষিত অস্বাভাবিকতা, ‘বিকৃতির’ ছবি। এই উত্তাল সময়ে বের্ন্ড আর হিলা বেসার তৈরি করে নেন নিজেদের আলাদা একটা ধারা। কিন্তু দুনিয়ায় এত্ত এত্ত ছবি তোলার বিষয় থাকতে তারা দু’জন এই বিষয় নিয়ে ছবি তুললেন কেন?

বের্ন্ড আর হিলা আদতে দুই লিঙ্গের দুইজন ভিন্ন মানুষ। তারা ছবি তোলেন একই সাথে। আর ছবির মালিকানা সমানে সমানে ভাগাভাগি করে নেন। তারা দুই জনই জর্মন দেশের। হিলা পুবের আর বের্ন্ড পশ্চিমের। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে হিলা পশ্চিম জর্মনের ডুসল্ডলফে চলে আসেন। তিনি ডুসল্ডফের কয়লা খনি, ই¯পাত কারখানা, লাইম স্টোন কারখানার স্থাপত্য শৈলী দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। ট্রেনের জানালা থেকে এসব দেখতে দেখতে এসবের প্রেমে পড়ে যান। আর বের্ন্ড এর ছেলেবেলা কেটেছে এমনি এক শিল্পাঞ্চলে। তার পূর্ব পুরুষেরা এমন কারখানাতেই কাজ করতেন। তাদের ছবির প্রধান বিষয় উনিশ শতকের এই সমস্ত স্থাপত্য, যা ঐ সময়টাতে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। এই সমস্ত স্থাপনা সমূহের স্থাপত্য শৈলী একটা নির্দিষ্ট সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সাথে সাথে অর্থনৈতিক বিকাশেরও। তাই তাদের মতে, মধ্যযুগের কোন স্থাপত্য সংরক্ষণ করা যেমন জরুরি তেমনি ভাবে এই সমস্ত শিল্প স্থাপনাগুলোও সংরক্ষণ করা জরুরি। এ কারণে তারা এই সমস্ত স্থাপনা সমূহকে ক্যামেরা বন্দী করে রাখার চেষ্টা শুরু করলেন। তাদের একটা ফক্স ভোগান ভ্যান ছিল। এই ভ্যানে করে ঘুরে বেড়াতেন আর ছবি তুলতেন। ঠিক যাযাবরের মতন, একজন হিলা তার প্রেমের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন হন্যে হয়ে, আরেকজন বের্ন্ড বারে বারে ফিরে যেতে চাইছেন তার ছেলেবেলায়। ঐ ভ্যানটার ভিতরেই ছিল তাদের সংসার, ছোট একটা ডার্করুম, আর ছেলে ম্যাকশ এর জন্য ছোট্ট একটা নার্সারি।

বেসারদের ছবির দেখলে মনে হয় এদের ছবিতে কম্পোজিশনের কোন কারিগরি নাই। খুব সাধারণ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে, কম্পোজিশন আসলেই সাদা মাটা। মূল বিষয়বস্তুর ডানে এবং বামে এবং উপরে নিচে অল্প একটু জায়গা ছেড়ে দেয়া। তাদের ওয়াটার টাওয়ার, গ্যাস টাওয়ারের ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যায়। তাদের একটা ছবির কথাই ধরা যাক, কোন একটা জমজ পানির টাওয়ার। ছবিটি খুব স্ট্রেইট, একদম সোজাসুজি। রেইল পথের জমজ পানির টাওয়ার। বড় বড়, মোটা, প্রায় গোল দু’টি টাওয়ার। এই দু’টি টাওয়ারের সংযোগ সিঁড়িগুলো জিক-জ্যাক করে উপরের ঐ ধূসর অংশ ধরে উঁচুতে উঠে গেছে। টাওয়ার দুটির নিচে ঝোপ ঝাড়, শ্রমিকদের বাগান যা ছবির মূল বিষয়বস্তুর মাত্র এক তৃতীয়াংশ জুড়ে। আর মূল বিষয়বস্তু ছবির ঠিক মাঝখানে। কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া। এই ছবিটির জন্য তারা অপেক্ষা করেছেন শীতকাল পর্যন্ত। যখন কুয়াশা থাকবে। এতে এই যমজ পানির টাওয়ারটার পিছনের যা কিছু আছে তা আর দেখা যাবে না, উধাও হয়ে যাবে।

যৌন নির্ভরতার উপাখ্যান

ন্যান গোল্ডিন
অনুবাদ
তাসলিমা আখ্তার
এটা এখনও আমার পরিবার

দশ বছর পার হল ব্যালাড বেরিয়েছে এবং সত্যিই আমি আর বইটির দিকে ফিরে তাকাইনি। ওটা তখনকার বিষয় ছিল; আর এখন এটা এই সময়ের। আমার লিখিত এবং আলোকচিত্রের দুই ধরনের ডায়েরির কাজই আমি অব্যাহত রেখেছি। আমার জন্যে এগুলো অতীতের দেখভালের কাজ করে, আর বর্তমানে আমাকে পরিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করার সুযোগ করে দেয়। আমি এই বইতে ছবিগুলো রেখেছিলাম যাতে করে নস্টালজিয়া কখনও আমার অতীতকে বর্ণিল করতে না পারে। আমি টের পাই আমার নিজের জখম হবার ছবিগুলো আমি তুলেছিলাম যাতে আমাকে যে মেরেছিল সে মানুষটির কাছে আমি আর কখনও ফিরে না যাই।

আমি আমার জীবনের রেকর্ড রাখতে চেয়েছিলাম যাতে কেউ কখনও এতে রং চড়াতে না পারেঃ কোন নিরাপদ কিংবা পরিচ্ছন্ন বয়ান নয়, বরং চেয়েছি আসলেই যা ঘটেছিল এবং অনুভূত হয়েছিল তারই একটা রেকর্ড রাখতে। তবে আমি যা ভেবেছিলাম আলোকচিত্র ততটা কার্যকর ভাবে স্মৃতি ধরে রাখতে পারে না। এই বইয়ের অনেক মানুষই এখন মৃত, বেশিরভাগই ছিল এইডসে আক্রান্ত। আমি ভেবেছিলাম এই হারানোর বেদনা আমি আলোকচিত্রের মাধ্যমে দূরে সরিয়ে রাখতে পারব। আমি সবসময় ভেবেছি কারও কিংবা কোনকিছুর ছবি যদি আমি যথেষ্ট পরিমাণ তুলে রাখি, তাহলে আমি কখনওই সেই ব্যক্তিকে হারাব না, হারাব না সেই স্মৃতি, হারাব না সেই জায়গা। কিন্তু ছবিগুলোই দেখিয়ে দিচ্ছে আমি কতটা পরিমাণে হারিয়েছি। এইডস সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। সেইসব মানুষ যারা আমাকে সবচেয়ে ভালভাবে চিনত, বুঝত, সেইসব মানুষ যারা আমার ইতিহাস বহন করেছে, যাদের সাথে আমি বেড়ে উঠেছিলাম এবং যাদের সাথে একসাথে বৃদ্ধ হবার কথা ভেবেছি তারা সবাই চলে গেছে। খুব অল্প সময়েই আমাদের ইতিহাস কাটা পড়ে গেছে।

চারপাশের মানুষজনকে হারানোর ফলে নিজেকে হারানোরই একটা অনুভূতি হয়। কিন্তু একইসাথে ঐ বৃহত্তর পরিবারটা এখনও চলছে এই অনুভূতিও কাজ করে। এইডস সব দিক থেকেই আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। নিজ পরিমণ্ডলের মানুষগুলো যখন মারা যাচ্ছিল, নিজেকে ধ্বংস করার মহিমা পরিণত হয় একটা বেয়াড়া প্রশ্রয়ে: আত্ম-ধ্বংসী শিল্পীদের যে রোমান্টিক কল্পনা, দুর্ভোগ কিংবা যন্ত্রণা ছাড়া সৃষ্টিশীল কাজ হয় না, সৃষ্টিশীলতা ভীষণ ভালোলাগার এক অনুভূতি কিংবা চরম অতিরিক্ততা থেকেই আসেÑ এসব ভাবনা পাল্টে যায়। আমাদের জীবনে মৃত্যুর উপস্থিতি বেঁচে থাকার একটা সত্যিকার ইচ্ছা, বাঁচার জন্যে পরস্পরকে সাহায্য করা, পরস্পরের কাছে হাজির থাকার একটা ইচ্ছা নিয়ে এসেছিল। শুরুতে ড্রাগস সব কিছু তুঙ্গে তোলার বিষয় ছিল, শেষে সেটাই পরিণত হল শেকলে। আমি ড্রাগস নিতাম মূলত অনেক বেশি স্বপ্ন দেখার, অনেক বেশি স্বচ্ছতা পাবার জন্য, নিজের ভেতরের সব ধরনের বাধা ডিঙ্গানো, পরিপূর্ণভাবে স্বতঃস্ফূর্ত এবং বন্য হয়ে ওঠার জন্য। অনেক দিন এটা কাজও করেছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এটা চালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন ছিল। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যকার সময়ে যখন আমি ব্যবহারের সীমা ছেড়ে অপব্যবহারের দিকে চলে গিয়েছিলাম তখন আমার জগত ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

১৯৮৮ সালে ব্যালাড এর প্রথম প্রকাশের দু বছর পর, আমি ড্রাগস এবং এলকোহল ছাড়ার জন্য একটা ক্লিনিকে ভর্তি হই। ব্যালাড এর একটা কপি আমি আমার সাথে নিয়েছিলাম। অন্য রোগীদের ড্রাগস এবং যৌনতা বিষয়ে আগ্রহ তৈরির কারণ হতে পারেÑএই বলে নার্সরা প্রথমেই বইটি নিয়ে নিল। হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় দু মাস আমি আমার কাজ দেখার অনুমতি পাইনি, এমনকি আমার ক্যামেরা ধরারও। কিশোর বেলার পর এই প্রথমবারের মত আমি আমার বোঝাপড়া এবং অভিজ্ঞতা বাঁচিয়ে রাখার যে মাধ্যম ছবি তোলা, সেটা করতে সক্ষম হইনি। আমার মনে হয় ড্রাগস থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় ক্যামেরা হাতে না থাকাটা আমার বিক্ষুব্ধটাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। হাসপাতালের চৌহদ্দিতে আমি যখন চিকিৎসার মাঝামাঝি পর্যায়ে ঢুকলাম; আমাকে আমার ক্যামেরা ফেরত দেওয়া হল। আমি সেলফ পোর্ট্রেট’র (আত্ম-প্রতিকৃতির) একটি সিরিজ শুরু করি যেটা আমার শীঘ্রই সেরে উঠার ক্ষেত্রে নির্ধারক হয়ে ওঠে। প্রতিদিন নিজের ছবি তোলার মধ্য দিয়ে আমি নিজেকে খুঁজে পেতে নিজের অবয়ব ফিরে পেতে সক্ষম হই। ওই সময়েই আমি ডে-লাইট (দিনের আলো) বিষয়টাও আবিষ্কার করি, এর আগে ফটোগ্রাফী যে আলোর সাথে সম্পর্কিত আমি এটা জানতামই না। আমি সবসময়েই ভাবতাম এভেইলেবেল লাইট (স্বাভাবিক আলো) বলতে বোঝায় শেষরাতের বারের লাল বাল্বের আলো।

ফলে এই নতুন কাজ—ড্রাগস ছাড়া আমার প্রথম ছবিগুলো আক্ষরিক এবং রূপক দুদিক থেকেই অন্ধকার থেকে আলোতে আসার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সেই থেকে এ পর্যন্ত আমি যত কাজ করেছি ওইটাই ছিল যাত্রা বিন্দু। এখন আমার ছবিগুলো অনেক বেশি নিজের সাথে বোঝাপড়ার, নির্ঝঞ্ঝাট, আগের মত বাড়াবাড়ি আচরণের বিষয় নয়, যদিও সবকিছুর পরও আছে সীমাকে অতিক্রমের আকাঙ্ক্ষা। ছবিগুলোর মাঝের শক্তি এখন অন্যরকম, অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট, অনেক বেশি স্বচ্ছ। এখানে আলো আছে এবং অন্ধকার আছে, আছে এই দুয়ের মাঝেরও যা কিছু। ফটোগ্রাফি আমার জন্য হয়ে পড়েছে মুক্তির দিশা। এটা আমার অধোগতিকে বুঝতে এবং আমার পুনর্গঠনে সাহায্য করেছে।

আমার চারপাশের মানুষজনের ছবি এখনও আমি তুলছি। ব্যালাডেরও অনেক চরিত্র যেমন ডেভিড, ব্র“স, গ্রীয়ার, কীডথ, শ্যারন, ভিভিয়েন এবং তার ন’ বছর বয়সী ছেলে ওরাও আমার ছবিতে আছে। ফলে শিশুদের মধ্য দিয়ে এর মাঝে একটি ধারাবাহিকতাও থাকছে। আমার বন্ধুদের পরিবার এখনও পারস্পরিক নির্ভরতা, ধারাবাহিকতা, ভালবাসা এবং মমত্ববোধের ওপর ভর করে আছে। আমার বন্ধু এবং প্রেমিকদের মাঝে আমি কোন আবেগীয় দূরত্ব তৈরি করি না। আমি বিশ্বাস করি না আলোকচিত্র সময়কে থামিয়ে দেয়। আমি এখনও আলোকচিত্রের সত্যতায় বিশ্বাস করি যা আমাকে এই সময়ে সেকেলে করে তুলেছে। আমি এখনও বিশ্বাস করি ছবি জীবনকে নির্জীব না করে বরং বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ব্যালাডের ছবিগুলো বদলায়নি। কিন্তু কুকি আর নেই, কেনি নেই, মার্ক নেই, ম্যাক্স নেই, ভিট্টোরিও আর নেই। আর তাই আমার কাছে এই বইটি এক বিরাট হারানোর বেদনা সংকলন একইসাথে ভালবাসারও উপাখ্যান।

ন্যান গোল্ডিন, মার্চ ১৯৯৬

খসড়া প্রেম; বিষয় কুদেলকা !

এমদাদুল হক

দৃশ্যত সহজ ও সাধারণ, প্রকৃত প্রস্তাবে জটিল, অসাধারণ এবং মাঝে মাঝে রহস্যময়; প্রায়শই ম্যাজিক মনে হয়। মলাটের ভিতরের পাতাগুলো ঘোরাচ্ছন্ন করে রাখে আমাকে। সাদা-কালো ছবি, প্রতি পাতায় বিস্ময়! ছবির চরিত্রগুলা আসে পুরাণ থেকে, আসে দৃশ্যকাব্য থেকে, আসে কোন এক উপন্যাস থেকে কিংবা এ সকল চরিত্ররাই পরবর্তীতে হয়ত বাস্তব থেকে পুরাণে যায় কিংবা দৃশ্যকাব্যে জায়গা করে নেয়। চরিত্রগুলোর চেহারার গড়ন, অভিব্যক্তি একরকমের নাটকীয়তার জন্ম দেয়। ছেষট্টিটি ছবি সম্বলিত তার একখানা চটি বই; আমার বিছানায়। আমি তারে খুঁজি, খুঁজতে থাকি, ক্ষণে ক্ষণে, অনেক সময় আবার প্রায় সময়। তারে পাই না; তার আলোকচিত্র নিয়েই আমি সন্তুষ্ট থাকি, থাকতে হয়। তারে বোঝার চেষ্টা চালাই। সে আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করে। বুঝি না পুরোপুরি, বুঝতে চাই, আরও জানতে চাই।

ব্যাগ ভর্তি ফিল্ম লইয়া অনেকদিন পর নিজের পাড়ায় ফেরত আসেন, ফিল্ম ডেভেলপ করেন কিংবা করেন না, কন্ট্রাক প্রিন্ট করলেন কিংবা করলেন না; আবার ব্যাগ ভর্তি নতুন ফিল্ম নিয়া বাইরইয়া গেলেন! মানুষটার কি ঘর সংসার নাই? বউ পোলাপাইন নাই? আমি ধন্দে পইড়া যাই।

 

বড় ভাই কয় লোকটা ক্যামেরা আর স্লিপিং ব্যাগ নিয়া ঘুইরা বেড়ান পথে পথে, তার আসলে কোন নির্দিষ্ট জায়গা নাই, যখন ছবি তুলতে বের হন তখনও তিনি জানেন না কই যাইতাছেন, স্লিপিং ব্যাগটা যখন রোল করে তখনও লোকটা নিশ্চিত না আইজ কোথায় রাইত কাটাইব! ঘুম যদি এতই জরুরি হয় তাইলে যে কোন জায়গাতেই ঘুমানো যায়, তাই এই বিষয়ে উনি চিন্তিত না। তিনি হাঁটেন আর ছবি তোলেন, ছবি তোলেন আর হাঁটেন। দিনের আলো ডুব মারলেই কেবল তিনি হাঁটা বন্ধ করেন, যেখানে হাঁটা থামান, সেইখানেই নরম ঘাসের উপর স্লিপিং ব্যাগটা বিছান, আর ভোরের আলোয় পাখির ডাকে প্রত্যুষে জাইগা উঠেন; একই জায়গায়! আবার হাঁটতে শুরু করেন। এইটাই তার জীবন! কয় কি হালায়? এমন ‘ছবি পাগলা’ তো জীবনে কম দেখছি। একদিন বৃদ্ধ হবেন, ছবি তুলতে আর সক্ষম থাকবেন না, এই বোধ থেকেই হয়ত এই লোক তার জীবনের প্রতিটি দিন ছবি তুলতেছেন। অথচ কেউরে ছবি দেখান না। বছরের পর বছর পইড়া থাকে তার নেগেটিভ। প্রিন্টও করেন না। দশ হাজার নেগেটিভ এখনও প্রিন্ট হয় নাই! তাইলে কেন ছবি তোলে লোকটা? দিনে দিনে অনেক কথা জমাইয়া রাখছি তারে জিগামু বইলা, কোন এক দিন কাছে পাইলে, প্রথমে একটা সালাম দিমু। পরে একটু সেলাম করুম তারপর জিগামু শইলটা ভালা?

হাঁটতে হাঁটতে ঢুইকা পরলেন পূর্ব ইউরোপের স্লোভাকিয়ার ক্লেনোভ্যেকের একটা রুমের মইধ্যে; আশ্চর্য হই, আপনে মানুষের এমন অভিব্যক্তি কি কইরা তোলেন? আমি খুঁইজা পাই না। মানুষজনের কি কোন সংশয় নাই আপনেরে নিয়া? নাকি আপনেরে কেউ পর ভাবে না? আপনে কি তাদের আপন লোক? ছবির লোকটা বিমর্ষ ছিল বেশ, হয়ত তার মন খারাপ, হয়ত তার পরিবারের কেউ মারা গেছে কিংবা অন্য কোন কারণে তার মনে বেজায় কষ্ট। হয়ত লোকটা কাঁদতে ছিল মহিলাটার সামনে। তখন মহিলাটা হয়ত সেই মানুষটার কান্না সহ্য করতে না পাইরা মানুষটার মাথা বুকে জড়াইয়া ধরল তার ডান হাতে, মানুষটারে শান্ত করার চেষ্টা করতাছিল, ভরসা দিতাছিল, ¯েœহ দিয়া কষ্ট ভুলাইয়া দিতাছিল, মহিলাটা বইসা ছিল একটা জানালার সামনে। জানালায় একটা সাদা পাতলা পর্দা আছিল, আর লোকটা দাঁড়ায়া ছিল মহিলাটার পাশে। লোকটার হাত ঝুলতেছিল। এই বিমর্ষতার মাঝে হয়ত একটু আশ্রয় খুঁজে পাইল লোকটা, তাদের চেহারায় এক ধরনের বিমর্ষতা বর্তমান থাকল; সেই ছবি আপনে তুললেন। আবার মহিলাটা আপনার দিকে তাকাইয়াও ছিল! আচ্ছা, মানুষগুলার কি এত দুঃখ?

তার ছবির বিশ্লেষণ আমি জানি না, বুঝি না, পারি না, পারি নাই। শুধু জানি তার ছবি আমাকে মোহিত করে। কোন কিছুর মোহে পড়লে, মোহের কারণ যদি জানা যায় তাইলে নাকি এইটারে ভালোলাগা কয় আর যদি কারণটা পাওয়া না গেল, তারে নাকি কয় ভালবাসা। এমন একটা ভালবাসা হইয়া গেছে এই মানুষটার ছবির সাথে। আমি আরও কাছে যেতে চাই। প্রেম বাড়তে থাকে…

 

ফটোগ্রাফী

সুকুমার রায়

‘সুন্দর’ বস্তু বা দৃশ্যের যথাযথ ফটোগ্রাফ লইলেই তাহা ‘‘সুন্দর’’ ফটোগ্রাফ হয় না। কারণ, আমাদের চোখের দেখা ও ফটোগ্রাফীর দেখায় অনেক প্রভেদ। জিনিসের গঠন ও আকৃতি ফটোগ্রাফে চাক্ষুষ প্রতিবিম্বেরই অনুরূপ হইলেও প্রাকৃতিক বর্ণবৈচিত্র্য ফটোগ্রাফে কেবল ঔজ্জ্বল্যের তারতম্য মাত্রে অনূদিত হইয়া অনেক সময় ভিন্ন মূর্তি ধারণ করে। অনেকেই লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন, সাধারণত হরিদ পীতাদি উজ্জ্বল বর্ণ ফটোগ্রাফে অত্যন্ত ম্লান দেখা যায় এবং নীল ও নীলাভ বর্ণগুলি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হইয়া পড়ে।

সুতরাং আকাশের নীলিমা ও মেঘের শুভ্রতা একই রূপ ধারণ করায় শাদা কাগজ হইতে তাহাদের পার্থক্য করা কঠিন হইয়া পড়ে। শ্যামল প্রান্তরের মধ্যে প্রকৃতির স্নিগ্ধোজ্জ্বল কারুকার্য সাধারণ ফটোগ্রাফে একঘেয়ে কালির টানের মতো মিলাইয়া যায়। অবশ্য ফটোগ্রাফীর বর্তমান উন্নত অবস্থায় এ সকল দোষের সংশোধন অসম্ভব নহে এবং বর্ণের ঔজ্জ্বল্য ফটোগ্রাফে যথাযথভাবে প্রকাশ করিবারও উপায় আবিষ্কৃত হইয়াছে।

কিন্তু শিল্পের দিক দিয়া আর একটি গুরুতর সমস্যা ও অন্তরায় রহিয়াছে।

ঘোলাটে ছবির আখ্যান

তানজিম ওয়াহাব

 

স্যালন  ফটোগ্রাফির আলোচনায় স্যালন  পেইন্টিং থেকেই ঘুরে আসতে হবে। প্যারিসে ১৭২৫ সালে স্যালন’’র প্রচলন ঘটে যখন ফরাসি সরকার শিল্পমান যাচাই আর শিল্পপ্রদর্শনী আয়োজনের লক্ষে তৈরি করে এক একাডেমি একাদেমি দে ব্যু আর্ট)। একাডেমি স্বীকৃত না হলে কারো ছবি প্রদর্শন হতো না, যার সিদ্ধান্ত নিত শুধুমাত্র সরকার নির্ধারিত বাক্তিবর্গ। তাদের পছন্দের তালিকায় ছিল বাইবেলীয় আখ্যান , পৌরাণিক বিষয়বস্ত যা শিল্পীর কল্পনাশক্তি নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করে বটে, তবে তা বাস্তবতা বিবর্জিত। চিত্রকলার ইমপ্রেসনিজম আন্দোলনের সময় এই ধারার প্যারিস স্যালনের সাথে ইম্প্রেসনিস্ট শিল্পীদের সরাসরি সংঘাত ঘটে। প্যারিস স্যালনের শিল্পের একক সংজ্ঞায়ন তারা নাকচ করে দেয়। যেমন ধরুন শিল্পে নগ্নতা নিয়ে প্যারিস স্যালনের ভাষ্য। তাদের ভষ্য মানুষের নগ্নতা (বিশেষ করে নারীর) শিল্পে শুধুমাত্র উত্তীর্ণ হতে পারে যখন তা আবেদনময়, কিন্তু নেংটো উপস্থাপন হল শিল্পবিমুখ অশ্লীলতা। ইংরেজিতে ন্যুড আর নেকেড এর সংজ্ঞায়ন জটিলতা বলতে পারেন। বুঝেন ঠ্যালা? ইমপ্রেসনিস্ট আর রিয়েলিস্ট শিল্পীরা প্রতিবাদস্বরূপ রীতিমত ব্যাঙ্গ করা শুরু করল। রিয়েলিস্ট পেইন্টার অনরে দোমিয়ের সেইসময়ের অসংখ্য ক্যারিকেচার স্যালন পেইন্টিংকে ব্যাঙ্গ করে বুর্জোয়া শিল্পচর্চা হিসেবে।

বিতর্ক শুরু হলেও  স্যালন  পেইন্টিং তার নির্দিষ্ট চরিত্রেই অনড় থাকে- অতি নান্দনিক, কাল্পনিক দৃশ্যায়ন, আলোছায়ার নাটকীয়তা আর সুন্দর, মঙ্গলময় জীবনের গুণকীর্তন। । কেন হঠাৎ স্যালন পেইন্টিং নিয়ে বললাম?

আলোকচিত্রের চোখে দেখা

এডওয়ার্ড ওয়েস্টন

অনুবাদ: সাইফুল হক অমি

মূলত এই ভুল ধারণা আতঙ্কজনক সব অনাসৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াল। অদ্ভুত পোশাকের ব্যবহার থেকে শুরু করে অর্থহীন আউট অফ ফোকাস—এ সবকিছুই করা হয়েছিলো শিল্পের দোহাই পেড়ে।

আলোকচিত্র উল্টা পথে চলার পেছনে এইটাই একমাত্র কারণ নয়। আসল সংকট তৈরি হয়  ভ্রান্তসব মানদণ্ড খাঁড়া করার মধ্যে।  চিত্রকলার অনুরূপ ফটো-পেইন্টিং  তৈরি করা আলোকচিত্রির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল।  আলোকচিত্র মাধ্যমের নিজস্ব প্রকৃতি বিরোধী একেবারে বেখাপ্পা চর্চায় নিয়োজিত থাকল ফটো-পেইন্টাররা। পরিণতিতে, আলোকচিত্র মাধ্যমের প্রতিটা গুণগত বিকাশ সেই সব অবিমৃশ্যকারীদের সামনে একেকটা বাঁধা তৈরি করল। আলোকচিত্র যে বিপুল সৃষ্টিশীল সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল, চিত্রকলাবাদী ধারার প্রভাব  স্বীকৃতি লাভের সেই সময়টা অনেক পিছিয়ে দেয়। দৃশ্যজগত উন্মোচনের নতুন উপায় হাতে পেয়ে যাদের আবিষ্কারে মনোযোগী হবার কথা তারাই বরং সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন মাধ্যমটির নিহিত সম্ভাবনা। আর চিত্রকলার মত করে আলোকচিত্র সৃষ্টির ভুত চাপে তাদের মাথায়, যা  ক্রমাগত আলোকচিত্রের সব মূল্যচেতনা থেকে মৌলিকভাবে তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে  ।

ফলাফল দাঁড়াল, যখন আমরা অতীতের সেরা কাজগুলোর হিসেব নিতে বসি তখন আমাদের প্রায়শঃ তাদের কাজগুলোই নির্বাচন করতে হয়, যারা নন্দনতত্ত্ব নিয়ে অতটা মাথা ঘামায় নি। সেটি হতে পারে কোনও বাণিজ্যিক ‘দাগরেটাইপ’ আমলের পোট্রেট, গৃহযুদ্ধের  প্রামাণ্য ছবি, কিংবা আমেরিকার যুদ্বক্ষেত্রের ছবি। মোট কথা, সেই সব শখের কিংবা পেশাদারি আলোকচিত্রীরা কাজ করেছিলেন তাদের আপন তাগিদে, আলোকচিত্র মাধ্যমটি আদতে কোনও শিল্পমাধ্যম কিনা তা নিয়ে তারা মোটেই বিচলিত ছিলেন না। ফলে সেই যুগ থেকে আমরা এমন কাজ খুঁজে পাই যা  সমকালীন সেরা কাজের মধ্যেও টিকে থাকতে পারে।

কিন্তু ইতিহাসের এই পর্বকে আমরা আশি বছর পর যখন আবেগ কাটিয়ে ঐতিহাসিক চোখ দিয়ে বুঝতে যাই, তখন দেখি আজও পরিস্থিতি আগের মতই তালগোল পাকানো। চিত্রকলার ঐতিহ্যের সাথে এখনও যা সেঁটে আছে-বিশেষ ধরনের টেক্সচারের পর্দা, নেগেটিভের উপর হাতের কাজ; আর ধরা-বাধা কম্পোজিশনের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়।  যারা ছাকনি দিয়ে কুয়া থেকে জল তোলার পণ্ডশ্রম করে তাদের পক্ষেই ক্যামেরা দিয়ে চিত্রকলা তৈরির কারবারে নামা সম্ভব! ফটো-পেইন্টিং  প্রবণতার  পেছনে এই বদ্ধমূল ধারনা ছিল যে, সরাসরি তুলে আনা ছবি  নেহাতই একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফল আর তা স্বাভাবিক কারণেই শিল্প হতে পারে না। সেই শিল্পী তখন যান্ত্রিকতার অপবাদ ঘুচাবার জন্য বিশেষ সব কৌশল প্রয়োগ করতে শুরু করলো। এই পদ্ধতিতে নেগেটিভকে ধরা হয়েছিল নতুন কর্মপদ্ধতির সূচনা হিসেবে- যার প্রাথমিক রুক্ষ চেহারা হাত দিয়ে ঠিকঠাক করা হয় ঠিক ততক্ষন পর্যন্ত, যতক্ষণ  না এর  অ-শৈল্পিক উৎসের শেষ চিহ্নটুকু  মুছে যায়।

এটা হয়ত গায়ক গায়িকারা একজোট হয়ে যন্ত্রীদের বুঝিয়ে ফেলার মত যে, যন্ত্রীরা যে সুর সৃষ্টি করেন তা শিল্প নয়। কেননা তা সৃষ্টি হচ্ছে যন্ত্রীদের ব্যবহৃত যন্ত্র থেকে যা অবশ্যই প্রাথমিকভাবে একটি যান্ত্রিক পদ্ধতির ফলাফল। তখন যন্ত্রীরা  ফটো-পেইন্টিং এর  নজির কাজে লাগিয়ে সুরকে এমন একটি ফিতায় বন্ধী করতে পারবেন, যেন তারা ক্রমাগত তাকে পরিবর্তন করতে পারেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি সঙ্গীত-যন্ত্রের উৎকৃষ্ট সুরমূর্চ্ছনা মানব কণ্ঠের অন্ধ অনুকরণে পর্যবসিত হয়।  আলোকচিত্র মাধ্যমটির স্বরূপ বুঝতে হলে আমাদের  মূল দুইটি বিষয় বুঝতে হবে যা আলোকচিত্রকে অন্য গ্রাফিক আর্ট থেকে  পৃথক করে।