ন্যান গোল্ডিন
অনুবাদ
তাসলিমা আখ্তার
এটা এখনও আমার পরিবার
দশ বছর পার হল ব্যালাড বেরিয়েছে এবং সত্যিই আমি আর বইটির দিকে ফিরে তাকাইনি। ওটা তখনকার বিষয় ছিল; আর এখন এটা এই সময়ের। আমার লিখিত এবং আলোকচিত্রের দুই ধরনের ডায়েরির কাজই আমি অব্যাহত রেখেছি। আমার জন্যে এগুলো অতীতের দেখভালের কাজ করে, আর বর্তমানে আমাকে পরিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করার সুযোগ করে দেয়। আমি এই বইতে ছবিগুলো রেখেছিলাম যাতে করে নস্টালজিয়া কখনও আমার অতীতকে বর্ণিল করতে না পারে। আমি টের পাই আমার নিজের জখম হবার ছবিগুলো আমি তুলেছিলাম যাতে আমাকে যে মেরেছিল সে মানুষটির কাছে আমি আর কখনও ফিরে না যাই।
আমি আমার জীবনের রেকর্ড রাখতে চেয়েছিলাম যাতে কেউ কখনও এতে রং চড়াতে না পারেঃ কোন নিরাপদ কিংবা পরিচ্ছন্ন বয়ান নয়, বরং চেয়েছি আসলেই যা ঘটেছিল এবং অনুভূত হয়েছিল তারই একটা রেকর্ড রাখতে। তবে আমি যা ভেবেছিলাম আলোকচিত্র ততটা কার্যকর ভাবে স্মৃতি ধরে রাখতে পারে না। এই বইয়ের অনেক মানুষই এখন মৃত, বেশিরভাগই ছিল এইডসে আক্রান্ত। আমি ভেবেছিলাম এই হারানোর বেদনা আমি আলোকচিত্রের মাধ্যমে দূরে সরিয়ে রাখতে পারব। আমি সবসময় ভেবেছি কারও কিংবা কোনকিছুর ছবি যদি আমি যথেষ্ট পরিমাণ তুলে রাখি, তাহলে আমি কখনওই সেই ব্যক্তিকে হারাব না, হারাব না সেই স্মৃতি, হারাব না সেই জায়গা। কিন্তু ছবিগুলোই দেখিয়ে দিচ্ছে আমি কতটা পরিমাণে হারিয়েছি। এইডস সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। সেইসব মানুষ যারা আমাকে সবচেয়ে ভালভাবে চিনত, বুঝত, সেইসব মানুষ যারা আমার ইতিহাস বহন করেছে, যাদের সাথে আমি বেড়ে উঠেছিলাম এবং যাদের সাথে একসাথে বৃদ্ধ হবার কথা ভেবেছি তারা সবাই চলে গেছে। খুব অল্প সময়েই আমাদের ইতিহাস কাটা পড়ে গেছে।
চারপাশের মানুষজনকে হারানোর ফলে নিজেকে হারানোরই একটা অনুভূতি হয়। কিন্তু একইসাথে ঐ বৃহত্তর পরিবারটা এখনও চলছে এই অনুভূতিও কাজ করে। এইডস সব দিক থেকেই আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। নিজ পরিমণ্ডলের মানুষগুলো যখন মারা যাচ্ছিল, নিজেকে ধ্বংস করার মহিমা পরিণত হয় একটা বেয়াড়া প্রশ্রয়ে: আত্ম-ধ্বংসী শিল্পীদের যে রোমান্টিক কল্পনা, দুর্ভোগ কিংবা যন্ত্রণা ছাড়া সৃষ্টিশীল কাজ হয় না, সৃষ্টিশীলতা ভীষণ ভালোলাগার এক অনুভূতি কিংবা চরম অতিরিক্ততা থেকেই আসেÑ এসব ভাবনা পাল্টে যায়। আমাদের জীবনে মৃত্যুর উপস্থিতি বেঁচে থাকার একটা সত্যিকার ইচ্ছা, বাঁচার জন্যে পরস্পরকে সাহায্য করা, পরস্পরের কাছে হাজির থাকার একটা ইচ্ছা নিয়ে এসেছিল। শুরুতে ড্রাগস সব কিছু তুঙ্গে তোলার বিষয় ছিল, শেষে সেটাই পরিণত হল শেকলে। আমি ড্রাগস নিতাম মূলত অনেক বেশি স্বপ্ন দেখার, অনেক বেশি স্বচ্ছতা পাবার জন্য, নিজের ভেতরের সব ধরনের বাধা ডিঙ্গানো, পরিপূর্ণভাবে স্বতঃস্ফূর্ত এবং বন্য হয়ে ওঠার জন্য। অনেক দিন এটা কাজও করেছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এটা চালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন ছিল। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যকার সময়ে যখন আমি ব্যবহারের সীমা ছেড়ে অপব্যবহারের দিকে চলে গিয়েছিলাম তখন আমার জগত ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
১৯৮৮ সালে ব্যালাড এর প্রথম প্রকাশের দু বছর পর, আমি ড্রাগস এবং এলকোহল ছাড়ার জন্য একটা ক্লিনিকে ভর্তি হই। ব্যালাড এর একটা কপি আমি আমার সাথে নিয়েছিলাম। অন্য রোগীদের ড্রাগস এবং যৌনতা বিষয়ে আগ্রহ তৈরির কারণ হতে পারেÑএই বলে নার্সরা প্রথমেই বইটি নিয়ে নিল। হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় দু মাস আমি আমার কাজ দেখার অনুমতি পাইনি, এমনকি আমার ক্যামেরা ধরারও। কিশোর বেলার পর এই প্রথমবারের মত আমি আমার বোঝাপড়া এবং অভিজ্ঞতা বাঁচিয়ে রাখার যে মাধ্যম ছবি তোলা, সেটা করতে সক্ষম হইনি। আমার মনে হয় ড্রাগস থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় ক্যামেরা হাতে না থাকাটা আমার বিক্ষুব্ধটাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। হাসপাতালের চৌহদ্দিতে আমি যখন চিকিৎসার মাঝামাঝি পর্যায়ে ঢুকলাম; আমাকে আমার ক্যামেরা ফেরত দেওয়া হল। আমি সেলফ পোর্ট্রেট’র (আত্ম-প্রতিকৃতির) একটি সিরিজ শুরু করি যেটা আমার শীঘ্রই সেরে উঠার ক্ষেত্রে নির্ধারক হয়ে ওঠে। প্রতিদিন নিজের ছবি তোলার মধ্য দিয়ে আমি নিজেকে খুঁজে পেতে নিজের অবয়ব ফিরে পেতে সক্ষম হই। ওই সময়েই আমি ডে-লাইট (দিনের আলো) বিষয়টাও আবিষ্কার করি, এর আগে ফটোগ্রাফী যে আলোর সাথে সম্পর্কিত আমি এটা জানতামই না। আমি সবসময়েই ভাবতাম এভেইলেবেল লাইট (স্বাভাবিক আলো) বলতে বোঝায় শেষরাতের বারের লাল বাল্বের আলো।
ফলে এই নতুন কাজ—ড্রাগস ছাড়া আমার প্রথম ছবিগুলো আক্ষরিক এবং রূপক দুদিক থেকেই অন্ধকার থেকে আলোতে আসার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সেই থেকে এ পর্যন্ত আমি যত কাজ করেছি ওইটাই ছিল যাত্রা বিন্দু। এখন আমার ছবিগুলো অনেক বেশি নিজের সাথে বোঝাপড়ার, নির্ঝঞ্ঝাট, আগের মত বাড়াবাড়ি আচরণের বিষয় নয়, যদিও সবকিছুর পরও আছে সীমাকে অতিক্রমের আকাঙ্ক্ষা। ছবিগুলোর মাঝের শক্তি এখন অন্যরকম, অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট, অনেক বেশি স্বচ্ছ। এখানে আলো আছে এবং অন্ধকার আছে, আছে এই দুয়ের মাঝেরও যা কিছু। ফটোগ্রাফি আমার জন্য হয়ে পড়েছে মুক্তির দিশা। এটা আমার অধোগতিকে বুঝতে এবং আমার পুনর্গঠনে সাহায্য করেছে।
আমার চারপাশের মানুষজনের ছবি এখনও আমি তুলছি। ব্যালাডেরও অনেক চরিত্র যেমন ডেভিড, ব্র“স, গ্রীয়ার, কীডথ, শ্যারন, ভিভিয়েন এবং তার ন’ বছর বয়সী ছেলে ওরাও আমার ছবিতে আছে। ফলে শিশুদের মধ্য দিয়ে এর মাঝে একটি ধারাবাহিকতাও থাকছে। আমার বন্ধুদের পরিবার এখনও পারস্পরিক নির্ভরতা, ধারাবাহিকতা, ভালবাসা এবং মমত্ববোধের ওপর ভর করে আছে। আমার বন্ধু এবং প্রেমিকদের মাঝে আমি কোন আবেগীয় দূরত্ব তৈরি করি না। আমি বিশ্বাস করি না আলোকচিত্র সময়কে থামিয়ে দেয়। আমি এখনও আলোকচিত্রের সত্যতায় বিশ্বাস করি যা আমাকে এই সময়ে সেকেলে করে তুলেছে। আমি এখনও বিশ্বাস করি ছবি জীবনকে নির্জীব না করে বরং বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ব্যালাডের ছবিগুলো বদলায়নি। কিন্তু কুকি আর নেই, কেনি নেই, মার্ক নেই, ম্যাক্স নেই, ভিট্টোরিও আর নেই। আর তাই আমার কাছে এই বইটি এক বিরাট হারানোর বেদনা সংকলন একইসাথে ভালবাসারও উপাখ্যান।
ন্যান গোল্ডিন, মার্চ ১৯৯৬