অলিভার লুগন
অনুবাদ
ওয়াহিদ সুজন ও সম্পাদনা পর্ষদ
আমরা যদি আজও ডকুমেন্টারির মত একটা নিত্য পরিবর্তনশীল ধারণার অর্থ ভালভাবে বুঝতে চাই, দুর্ভাগ্যের বিষয় তাতে পিছনে ফিরার প্রয়োজন পড়ে খুব সামান্যই। সময়ান্তরে ডকুমেন্টরি কথাটার অর্থ নানান রূপ এবং ভঙ্গি অদল বদলের মধ্যে দিয়ে গেছে। ফলত, পরস্পর বিরোধী সংজ্ঞাও পয়দা হয়েছে। ডকুমেন্টরি ধারণাটির অসঙ্গতি এর নিজস্ব ইতিহাসের কোন শেকড়ে জড়িয়ে আছেÑ অতীতে পুনর্দৃষ্টি কেবল তার হদিসটুকু উন্মোচিত করবে। ডকুমেন্টরি অভিধাটি আদতে কি অর্থ ব্যক্ত করে সে বিষয়ে আজও কেউ নিশ্চয় জ্ঞান হাসেল করতে পারে নাই ফিল্মের কথা টানলে, আপাত একটা সংজ্ঞা পয়দা করা সম্ভবÑ মোটা দাগে যা কিছু ফিকশন নয় তাই ডকুমেন্টরি। কিন্তু ফটোগ্রাফিতে ডকুমেন্টরির বিপরীতে এমনতর কিছু দেখানো কঠিন, কেননা ফটোগ্রাফির মধ্যে কোন জিনিসকে আমরা ফিকশন বলে আলাদা করে দেখাব? কাজেই ডকুমেন্টরি অভিধাটির প্রকৃত পরিসর নির্ধারণের মুশকিলটাও এখানেই নিহিত। সে যাইহোক, অর্থবোধকটার এই অস্পষ্টতা চলার পথে বিশেষ বাধা হয়ে দাঁড়ায় নাই; বরং এর সাফল্য এবং ছড়িয়ে পড়ায় সহায়ক বনেছে, জগত জুড়ে নানান কিসিমের নির্মাতারা নিজের কাজটাকে এই তকমায় মুড়িয়ে চালিয়ে দিয়েছে, মানুষের কাছে ফেরি করেছে। গত প্রায় এক শতক জুড়ে ডকুমেন্টরির প্রভাব-প্রতিপত্তির বড় কারণ রয়েছে অভিধাটি দেদারসে ব্যবহারের এই অবাধ স্বাধীনতায়।
অবশ্য, অজস্র সংজ্ঞার এতসব অস্পষ্টতার মাঝেও এমন একটা উপাদানের সাধারণ উপস্থিতি ও ঐক্যসূত্র পাওয়া যাবে যা কোনকিছুকে ডকুমেন্টরি বলে আখ্যা দিতে চাইলে একান্তই আবশ্যিক। এটা হল ডকুমেন্টরির অন্তর্গত বাসনা, ডকুমেন্টরি চায়Ñ‘জগত-সংসারে যা কিছু যেভাবে আছে’Ñসে অবস্থার উন্মোচন, বিষয়বস্তুর গ্রহণযোগ্য ও প্রামাণিক তথ্য সরবরাহ; বাস্তবতার শুদ্ধ নিরলঙ্কার চরিত্র অক্ষুণ্ণœ রাখতে বাড়তি নান্দনিকতা পরিহার। এই সাধারণ ঐক্যমত্যের পরে সর্বত্রই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা শুরু হয়। সেটা হতে পারে কিভাবে একটা বিষয়ের বর্ণনা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে সেই প্রশ্ন, কিম্বা বেছে নেয়া বিষয়বস্তুর যথার্থতা বা জড়ো করা সাধারণ উপাদানগুলো ব্যবহারের ধরন নির্ধারণ নিয়ে। সে যাইহোক, ভিন্নতা ও বিতর্ক সত্ত্বেও ডকুমেন্টরির তিনটা পথই খোলা আছে সেটা পরিষ্কার— এনসাইক্লোপিডিক বা শিক্ষামূলক ধারা, ঐতিহ্য-সংরক্ষণ-বাদী ধারা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ধারা। এই তিনটি ধারার নান্দনিক রীতিনীতির দিকটাও বিবেচনা করা যেতে পারে; সে দিকে আমরা পরে প্রবেশ করব।
বিশ শতকের প্রথম দশকে শিক্ষামূলক এবং সংরক্ষণ-বাদী এই দুটি ধারা ডকুমেন্টরি শব্দটির শোভা বর্ধন করেছে। একই সময়ে ফরাসি দেশে ‘ফিল্ম ডকুমেন্টিয়ারে’ বলতে নির্দেশ করত ভ্রমণ বা সংস্কৃতি বিষয়ক শিক্ষামূলক ফিল্ম। ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে, প্রাথমিক তর্কগুলো চালু ছিল এনসাইক্লোপিডিক আর্কাইভিং ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মজুদ করণের মধ্যে। অবশ্য, ইতিমধ্যে সমাজ সংস্কারক এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো ফটোগ্রাফিকে কাজে লাগানো শুরু করেছে, নানা বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে, শহরের দারিদ্র্য ও শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে সরব হতে। যদিও ছবির এই যুদ্ধংদেহী উদ্দেশ্যের ব্যবহার প্রথমদিকে ডকুমেন্টরি সংশ্লিষ্ট ছিলনা। উনিশ শতকের ত্রিশের দশক পর্যন্ত এর সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল পুরোভাগে একচ্ছত্র জায়গা নিয়ে এবং যা এখনও সমান মাত্রায় জারি আছে। পরিভাষাটির শব্দার্থিক পরিবর্তন এসেছে প্রধানত অ্যাংলো-স্যাক্সন প্রভাবে। বস্তুত, দুই মহাযুদ্ধের সময়কালে আমেরিকা ও ব্রিটিশ লেখকরা ফরাসি ডকুমেন্টয়ারে শব্দটি এস্তেমাল করে। তারা প্রথমে সিনেমায় এবং পরে ফটোগ্রাফিতে ‘ডকুমেন্টায়ার’ কথাটা আনে। স্টেজ না করে তোলা সাক্ষাৎ দুনিয়ার ছবি এবং সামাজিক বাস্তবতা উপস্থাপনের কাজগুলো বুঝাতে এর সাধারণ ব্যবহার ঘটে। এইভাবে ডকুমেন্টরি অভিধাটি সত্যের তালাশ কিম্বা ঘটনার বিবরণ সন্ধানে জোরালো নৈতিক এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধ আশ্রয়ী ব্যঞ্জনা অর্জন করে। ইংরেজির মারফত ঘটা এই অবস্থান্তর ও নৈতিক মূল্য যোগকে শুকরিয়া জানাতে হয়। একইসাথে তা নান্দনিক আলোচনারও সূচনা করে অতঃপর ইউরোপে ফেরত আসে। তবে, সর্বজনস্বীকৃত-ভাবেই আমেরিকানদের চেয়ে জর্মান ও ফ্রান্সেই এর ব্যঞ্জনা ব্যাপকতা লাভ করেছে।
ঘটনা যাই হোক, এর অন্যান্য ব্যাখ্যাগুলোও কখনও সম্পূর্ণভাবে চুপসে যায় নাই, এমনকি অ্যাংলো-স্যাক্সন টেক্সট থেকেও না। ধাঁধার মত মনে হলেও, জিগা ভারটভকে প্রথম দিককার ব্রিটিশ তাত্ত্বিক জন গিয়ারসন এবং পল রুথা, ডকুমেন্টরির জনক হিশাবে সাব্যস্ত করেন নাই। বরং তারা নির্বাচন করলেন খুবই গতানুগতিক ধারার রোমান্টিক ও অতীতকাতর গবেষক রবার্ট ফ্লাহেট্রিকে। একইভাবে ফটোগ্রাফিতে জনকের মর্যাদা পেলেন পুরাতন দলিল দস্তাবেজের মোহাফেজকার ইউজেন আঁজে, ফ্লাহেট্রির মত ইনিও ছিলেন অতীতচারী। ‘ডকুমেন্টরি ঐতিহ্যের’ সিলসিলায় ত্রিশ দশক থেকে আঁজে পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণদের মধ্যে ছিলেন— হেনরি লি সেকউ, ম্যাথিউ ব্রাডি, জ্যাকব রিস, লুইস হাইন, পল স্ট্যান্ড, ওয়াকার ইভান্স, ডরথিয়া ল্যাঙ ও ফার্ম সিকিউরিটি এডমিনিস্ট্রেশন প্রমুখ। দেখা যাবে এদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলটাই প্রকট। এসব রেকর্ড কর্মে যেমন নাই বিধিবদ্ধটা, তেমনি নাই কোন যৌক্তিক শৃঙ্খলা। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় আঁজের সংরক্ষণ-বাদী দৃষ্টিভঙ্গি (ফটোগ্রাফি কোনকিছুকে জীবিত রাখে) এবং হাইনের সমাজ সংস্কারের বাসনা (ফটোগ্রাফি পরিবর্তন আনে) আর ইভান্সের আক্ষরিক অনুকৃতির মাঝে মূলত সম্পর্কটা কোথায়?
বাস্তবতার বিশ্বস্ত উপস্থাপনের ধরণ থেকেই পদ্ধতিগত পার্থক্য বড়সড় হয়ে আবির্ভূত হয়। নির্মাতার কি উচিত হবে বিষয়ের আপাত নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে অন্তরালে লীন হয়ে থাকা, অথবা প্রামাণ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য কি তার উপস্থিতি অপরিহার্য? নান্দনিক বিধিবদ্ধটা কাম্য নাকি সেটা বরং তিরষ্কারযোগ্য?