এডওয়ার্ড ওয়েস্টন
অনুবাদ: সাইফুল হক অমি
মূলত এই ভুল ধারণা আতঙ্কজনক সব অনাসৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াল। অদ্ভুত পোশাকের ব্যবহার থেকে শুরু করে অর্থহীন আউট অফ ফোকাস—এ সবকিছুই করা হয়েছিলো শিল্পের দোহাই পেড়ে।
আলোকচিত্র উল্টা পথে চলার পেছনে এইটাই একমাত্র কারণ নয়। আসল সংকট তৈরি হয় ভ্রান্তসব মানদণ্ড খাঁড়া করার মধ্যে। চিত্রকলার অনুরূপ ফটো-পেইন্টিং তৈরি করা আলোকচিত্রির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল। আলোকচিত্র মাধ্যমের নিজস্ব প্রকৃতি বিরোধী একেবারে বেখাপ্পা চর্চায় নিয়োজিত থাকল ফটো-পেইন্টাররা। পরিণতিতে, আলোকচিত্র মাধ্যমের প্রতিটা গুণগত বিকাশ সেই সব অবিমৃশ্যকারীদের সামনে একেকটা বাঁধা তৈরি করল। আলোকচিত্র যে বিপুল সৃষ্টিশীল সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল, চিত্রকলাবাদী ধারার প্রভাব স্বীকৃতি লাভের সেই সময়টা অনেক পিছিয়ে দেয়। দৃশ্যজগত উন্মোচনের নতুন উপায় হাতে পেয়ে যাদের আবিষ্কারে মনোযোগী হবার কথা তারাই বরং সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন মাধ্যমটির নিহিত সম্ভাবনা। আর চিত্রকলার মত করে আলোকচিত্র সৃষ্টির ভুত চাপে তাদের মাথায়, যা ক্রমাগত আলোকচিত্রের সব মূল্যচেতনা থেকে মৌলিকভাবে তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে ।
ফলাফল দাঁড়াল, যখন আমরা অতীতের সেরা কাজগুলোর হিসেব নিতে বসি তখন আমাদের প্রায়শঃ তাদের কাজগুলোই নির্বাচন করতে হয়, যারা নন্দনতত্ত্ব নিয়ে অতটা মাথা ঘামায় নি। সেটি হতে পারে কোনও বাণিজ্যিক ‘দাগরেটাইপ’ আমলের পোট্রেট, গৃহযুদ্ধের প্রামাণ্য ছবি, কিংবা আমেরিকার যুদ্বক্ষেত্রের ছবি। মোট কথা, সেই সব শখের কিংবা পেশাদারি আলোকচিত্রীরা কাজ করেছিলেন তাদের আপন তাগিদে, আলোকচিত্র মাধ্যমটি আদতে কোনও শিল্পমাধ্যম কিনা তা নিয়ে তারা মোটেই বিচলিত ছিলেন না। ফলে সেই যুগ থেকে আমরা এমন কাজ খুঁজে পাই যা সমকালীন সেরা কাজের মধ্যেও টিকে থাকতে পারে।
কিন্তু ইতিহাসের এই পর্বকে আমরা আশি বছর পর যখন আবেগ কাটিয়ে ঐতিহাসিক চোখ দিয়ে বুঝতে যাই, তখন দেখি আজও পরিস্থিতি আগের মতই তালগোল পাকানো। চিত্রকলার ঐতিহ্যের সাথে এখনও যা সেঁটে আছে-বিশেষ ধরনের টেক্সচারের পর্দা, নেগেটিভের উপর হাতের কাজ; আর ধরা-বাধা কম্পোজিশনের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। যারা ছাকনি দিয়ে কুয়া থেকে জল তোলার পণ্ডশ্রম করে তাদের পক্ষেই ক্যামেরা দিয়ে চিত্রকলা তৈরির কারবারে নামা সম্ভব! ফটো-পেইন্টিং প্রবণতার পেছনে এই বদ্ধমূল ধারনা ছিল যে, সরাসরি তুলে আনা ছবি নেহাতই একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফল আর তা স্বাভাবিক কারণেই শিল্প হতে পারে না। সেই শিল্পী তখন যান্ত্রিকতার অপবাদ ঘুচাবার জন্য বিশেষ সব কৌশল প্রয়োগ করতে শুরু করলো। এই পদ্ধতিতে নেগেটিভকে ধরা হয়েছিল নতুন কর্মপদ্ধতির সূচনা হিসেবে- যার প্রাথমিক রুক্ষ চেহারা হাত দিয়ে ঠিকঠাক করা হয় ঠিক ততক্ষন পর্যন্ত, যতক্ষণ না এর অ-শৈল্পিক উৎসের শেষ চিহ্নটুকু মুছে যায়।
এটা হয়ত গায়ক গায়িকারা একজোট হয়ে যন্ত্রীদের বুঝিয়ে ফেলার মত যে, যন্ত্রীরা যে সুর সৃষ্টি করেন তা শিল্প নয়। কেননা তা সৃষ্টি হচ্ছে যন্ত্রীদের ব্যবহৃত যন্ত্র থেকে যা অবশ্যই প্রাথমিকভাবে একটি যান্ত্রিক পদ্ধতির ফলাফল। তখন যন্ত্রীরা ফটো-পেইন্টিং এর নজির কাজে লাগিয়ে সুরকে এমন একটি ফিতায় বন্ধী করতে পারবেন, যেন তারা ক্রমাগত তাকে পরিবর্তন করতে পারেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি সঙ্গীত-যন্ত্রের উৎকৃষ্ট সুরমূর্চ্ছনা মানব কণ্ঠের অন্ধ অনুকরণে পর্যবসিত হয়। আলোকচিত্র মাধ্যমটির স্বরূপ বুঝতে হলে আমাদের মূল দুইটি বিষয় বুঝতে হবে যা আলোকচিত্রকে অন্য গ্রাফিক আর্ট থেকে পৃথক করে।