সোশাল রিয়ালিটির বাস্তবতা অভিযান

কলোনিয়াল পোর্ট্রেট থেকে ডেভেলপমেন্ট ডিসকোর্স

নাঈম মোহায়মেন

…পূর্ব বাংলার ফটোগ্রাফিতে বাস্তবতার আগমনের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গেলে পেইন্টারদের প্রসঙ্গটা চলে আসে, বিশেষ করে জয়নুল এবং পরবর্তীতে কামরুলের ভূমিকা। এখানে কলোনিয়াল আমলের ফটোগ্রাফারদের লিগাসি নিয়ে বিড়ম্বনাটা আরেকটু তীক্ষ্ণ হয়। দেশ-বিভাগের আগে যে ফটোগ্রাফির ধারা চালু ছিল তা যথেষ্ট ভাবে এই বাংলার ফটোগ্রাফিকে রিয়ালিজমের দিকে টেনে নিতে পারেনি (যদিও কিছু ফটোগ্রাফি স্টুডিও স্থাপন হয়েছিল)। এবং এই শূন্যতার কারণেই জয়নুলের কাজের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
জয়নুলের ভূমিকার কথা বলতে গেলে মন্বন্তরের কাজটি (‘ফ্যামিন সিরিজ’) ভালমতো বুঝতে হবে, এবং বিশেষত সেই সময়কার প্রচলিত চারুকলায় এর প্রভাবটাকে খতিয়ে দেখতে হবে। সেই সময়ের প্রচলিত ধারার ব্যাপারে শোভন সোম লিখেছেন:
‘অ্যাকাডেমিক কেতার পুরোধা শিল্পীদের ছবিতে বিষয় হিসাবে প্রাধান্য পেত নগ্নিœকা, অভিজাত বা ধনবান মানুষের অজুরায় আঁকা প্রতিকৃতি এবং অজুরায় আঁকা নানা বিষয়ের ছবি। বলা বাহুল্য, যেহেতু ছবি আঁকাই তাঁদের জীবিকার উপায় ছিল এবং সে সময় মুষ্টিমেয় ক্রেতাদের মধ্যে ছিলেন দেশীয় রাজন্যবর্গ, জমিদার, উচ্চপদস্থ রাজপুরুষ বা বণিক এবং এই ক্রেতাদের রুচি-মাফিক না আঁকলে জীবিকার সুরাহা সম্ভব ছিল না, এ কারণে এই শিল্পীদের পক্ষেও নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে পা ফেলা কঠিন ছিল। ঐ সব বিষয় ছাড়াও এঁরা এক ধরনের দৃশ্য-চিত্র আঁকতেন যা ছিল রোম্যান্টিক আবেগে আপ্লুত, যেমন ঘনায়মান সন্ধ্যায় প্রান্তরে নামাজি, বনান্তরালে পল্লীবধূ, গোচারণ শেষে গো-পালসহ রাখাল-বালক ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, বাস্তবতা-বর্জিত এই সব রোম্যান্টিক ছবির লক্ষ্য ছিল এক বিশেষ ধরনের ক্রেতা।’৪

এই প্রেক্ষিতটা লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, সেই সময়কার শিল্পীরা বাইরের পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবকে নিজেদের কাজে জায়গা দিত না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে, কলকাতায় বিদেশি সৈন্যের আনাগোনা, গ্রামে- গ্রামে ক্ষুধার্ত মানুষ না খেয়ে মরছে। অথচ এই পরিস্থিতিতে যামিনী রায় আঁকছে যিশু ও কৃষ্ণলীলার ছবি, যার খদ্দের কলকাতার উচ্চবিত্ত মানুষ অথবা আগন্তুক মার্কিন ও ইংরেজ সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসার। একই সময়ে ক্যালকাটা গ্র“প বিশ্ব রাজনীতির ব্যাপারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ না নিয়ে বরং দলীয় কর্মী-শিল্পী চিত্তপ্রসাদ, সূর্য রায়, রথীন মৈত্র ও সোমনাথ হোরকে পোস্টার আঁকার কাজে আটকে রেখেছেন। এমনকি নীরদ মজুমদারকে কৃষক সম্মেলনের মঞ্চ তৈরির কাজে ব্যস্ত রাখা হয়।
এই নির্লিপ্ত শিল্প পরিস্থিতিতে জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবি কলকাতার ভদ্রলোক সমাজে একটা হাতবোমার মত বিস্ফোরিত হয়। শোভন সোমের ভাষায়ঃ
‘জয়নুলের ছবিতেও আমরা প্রতিবাদ দেখি না; যে সমাজব্যবস্থা এই দুর্ভিক্ষ তৈরি করেছে, তার বিরুদ্ধে একটাও উত্তোলিত তর্জনী নেই। তার বিপ্রতীপে আছে নীরবে নিয়তিকে মেনে নেওয়া, আছে প্রতিবাদ-হীন মৃত্যু, কিন্তু প্রশ্ন নেই। তাঁর ছবির সামনে দাঁড়ালে দর্শক ভাবতে বাধ্য হন, কেন বিনা প্রশ্নে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ এই পরিণাম মেনে নিল। আমরা দর্শক হিসাবে ভাবতে বাধ্য হই, যুগ যুগ ধরে এই দেশ কেন এইভাবে ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। আর তখনই আমরা তাঁর ছবিতে নিজেদের স্বরূপ দেখে অনুভব করি যে, এই সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। তাঁর ছবিতে যা প্রতিবাদ-হীনতা বলে প্রতিভাত হয় বস্তুত তা প্রতিবাদকেই উসকে দেয়।’৫
জয়নুলের দুর্ভিক্ষ সিরিজের রূঢ়, মোটা, উগ্র, ড্রাই ব্রাশ স্ট্রোকগুলো নতুন এক ভাষার ইঙ্গিত দেয়। আলোচকরা বলেন যে, এই কাজের মধ্যে উঁচিয়ে ধরা মুঠিটা নেই। কিন্তু রাগ আছে প্রচুর। ভিক্ষুক, কুকুর, কাক এক জায়গায় মিলে গেছে ছবিগুলোতে। তাদের খাদ্য সন্ধানের স্থান এবং মৃত্যুর জায়গা মিলেমিশে আছে। হয়ত এক প্রজাতি মরলে সে অন্যের খাবারে পরিণত হবে। কলকাতার শিল্প-মহল জয়নুলের কাজ দেখে হতবাক হয় শুধু সোশাল রিয়ালিজমের থাপ্পড়ের জন্য নয়। তার সাথে যুক্ত হয় এই চিন্তাঃ ‘এ কোথা থেকে এলো, আমাদের প্রভাবের চিহ্ন পাচ্ছি না কেন?’ অনেকে তাকে বাক্সবন্দি করার জন্য ‘সোশাল রিয়ালিস্ট মুসলিম’ বলে আখ্যায়িত করে।
জয়নুলের সেই বড় ভাঙনের পর ফিরে যাবার পথ আর থাকে না। তার অনুগত কামরুল হাসান ও সফিউদ্দিনের কাজের সমন্বয়ে পেইন্টিংয়ের রোমান্টিক অতীতের সাথে একটা ভাঙন হয়ে যায়। ভারত বিভাগের পরে জয়নুলের প্রভাবে রিয়ালিজম পূর্ব পাকিস্তানের পেইন্টিংয়ে ঢুকে যায়। আমার ধারণা, এই জয়নুল স্কুল থেকেই রিয়ালিজমের ধারাটা ফটোগ্রাফির মধ্যে চলে আসে (বা, অনেকগুলো প্রভাবের একটা)। যেহেতু পূর্ববঙ্গের আলোকচিত্রে কলোনিয়াল বেঙ্গল ধারাটা দেশবিভাগের কারণে হারিয়ে যায়, ৫০ ও ৬০ দশকের ফটোগ্রাফি সেই কলোনিয়াল ধারাকে উপেক্ষা করে বরং চারুকলার জয়নুল ও অন্যান্যের প্রভাব গ্রহণ করে। পরের দশকের ফটোগ্রাফিতে বাস্তবতার উপস্থাপন জয়নুলের সেই ‘ফ্যামিন’ সিরিজের পরবর্তী ধাপ হিশাবে ভাবা যায়। যাত্রাপথে কোন এক সময়ে জয়নুলের এগ টেম্পেরা হয়ে যায় নাইব উদ্দিনের নেগেটিভ।

 

আদম সুরত: নমুনা ও নারায়ণ দাজি

মুসতাইন জহির

…হারাধন দে-র পূর্বসূরি, স্বজাতির মধ্যে ডাক্তার নারায়ণ দাজি (১৮২৮-১৮৭৫) যখন ক্যামেরা হাতে বের হন, তখন তিনিও এক প্রকার কর্তব্য কাজেই শরিক হন। তবে সে কর্তব্য তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের তরে খেটেছে অনেকটা! বিজাতির মধ্যে ইউলিয়ম জনসন আর বেনিয়ামিন সিম্পসনও এইকাজে ভূ-ভারতের ‘আদম’ সুরতের নমুনা সংগ্রহে নামেন সেই সময়। নমুনা সংগ্রহের এই প্রকল্প-কলোনির জ্ঞান ও বিজ্ঞান প্রযোজনা, প্রশাসন পরিচালনা এবং পরিসংখ্যান সাজানোর বর্ণবাদী ভাবধারার উদ্দেশ্য ও বিধেয়’র অন্তর্ভুক্ত। কলোনির লগে এথনোগ্রাফি চর্চার কায়কারবারে ফটোগ্রাফি কি যোগান দিতে আসে, সেই আলাপে যাওনের আগে নারায়ণ দাজির দলভুক্ত হওনের বিষয়টা একটু বইলা নেয়া যাইতে পারে। দাজি বম্বে মেডিকেল কলেজ থন পাশ কইরা বাইর হন ১৮৫২ সনে, তখনও ফটোগ্রাফি জিনিসটা হাঁটি হাঁটি পা পা, উদ্ভাবিত হইছে মাত্র তের বছর। এরই ভিতরে ১৮৫৪ সনে বম্বে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি আর তার দুই বছর পরে কলকাতা এবং মাদ্রাজে অর্থাৎ ১৮৫৬ সনে ফটোগ্রাফিক সোসাইটি খাড়ায়া যায়। দাজি এলফিনস্টোন কলেজে ফটোগ্রাফিতে মাস্টারির সুযোগটা অল্পের জন্য হাত ছাড়া করেন। বম্বে ফটোগ্রাফিক সোসাইটির কাউন্সিল মেম্বার থাকেন, ১৮৫৭-৬১ পর্যন্ত। ভারতীয় আদম সন্তান (পিপল অব ইন্ডিয়া, ১৮৬৮-৭৫) নামে আট খণ্ডে যে বই বাইর হয় তার প্রথম খণ্ডে তার কাজ ছাপা হয়।

ভারতের ইতিহাসে ১৮৫৭ ইসায়ী’র সিপাহি বিদ্রোহ বা প্রথম ‘জাতীয় যুদ্ধ’ খ্যাত ইংরাজ বিরোধী সশস্ত্র পন্থা সরকার সামলে নিলে পরে, পুরাতন কায়দায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ক্ষমতা রাইখা উপনিবেশের এই ভাগটা শাসন-কর্তৃত্বে আর ধইরা রাখন যাইব না, সেই বিষয়ে রানীর সরকার নিশ্চিত হয়। শাসন-তান্ত্রিক কাঠামো আর প্রশাসনিক বিন্যাসে হাত লাগানোর ব্যাপারে তারা মনস্থ করে। এই ভাবনার প্রায়োগিক বন্দোবস্তে, বড় একটা দিক এন্তেজাম দিতে দরকার পড়ে সেনসাস বা আদমশুমারির। মাথা গোনার পাশাপাশি, কার মাথা কিভাবে কোন বর্গে ভাগ করবেন, বাটোয়ারায় কার লগে কারে মিলায়া কি পরিচয় দিবেন, কার মুখ কোনদিকে ঘুরাইবেন, সেই কাজে আরও জোরদার ভাবে বিশাল ভারতের কোনা-কাঞ্চি পর্যন্ত আদম সন্তানদের সম্প্রদায় গত আচার অভ্যাস, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ধার্য করণের কর্মযজ্ঞে ডাক পড়ে ফটোগ্রাফারদের। কারণ, উদ্ভাবনের পর থেইকা এই বিশ্বাসের জয়জয়কার হইতে থাকে যে, ক্যামেরাই একমাত্র জাদুযন্ত্র যা অবিকল, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশেষত্ব সহ প্রতিটা বিষয়ের আগাপাছতলা হুবহু গ্রেফতার করতে সক্ষম। বিবরণ এতই নিখাদ, নির্ভরযোগ্য ও চোখের অধিক বাস্তবতার (আটার ট্রুথ) তালাশ দিতে পারে, যাতে যাবতীয় সংশয় অমূলক হইয়া যায়। ফটোগ্রাফারের নিজের ইচ্ছা নিরপেক্ষ নিশ্চিত, নৈর্ব্যক্তিক রেকর্ড পাওয়া যায়। ক্যামেরা ফটোগ্রাফারের চোখ দিয়া দেখেনা, মানে ফটোগ্রাফার যা দেখেনা ক্যামেরার কাচ তাও দেখে এবং চোখ যা বাদ দিতে চায় ক্যামেরা তারেও টাইনা আনে। এই ক্ষমতা, মানুষের ইচ্ছার বাইরে গিয়া বাইরের দুনিয়া ধারণ করবার যে কেরামতি তারে মারগারেট ইভারসেন নাম দিছেন ক্যামেরার ‘জন্মান্ধ চোখ’। যে জানেনা সেন্সর কেমনে করতে হয়। এর লগে গলা মিলায়া, এলিজাবেথ এডওয়ার্ড আরও দুরন্ত সম্ভাবনা সাব্যস্ত করছেন, তার ভাষায় ‘ইতিহাসের কাচা রসদ’ কুড়ায়া আনতে ক্যামেরার বিকল্প হয় না।

এই আশ্বাস এত উচ্ছ্বাস ছড়ায়, দৃষ্টিভেদ কইরা গহীনের গোপন ‘সত্য’ আবিষ্কারের মোহ বাড়ায়া তোলে, চর্ম চক্ষে এতদিনকার অদেখাকে জয় কইরা আনার রোমাঞ্চে অনেকেই ক্যামেরার দিকে হাত বাড়াইতে শুরু করে। দ্য ক্যালকাটা কুরিয়ার ১৮৪০ এর ৫ই মার্চ ভারতের প্রথম দাগুয়েখ টাইপের বিস্ময় নিয়া একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এশিয়াটিক সোসাইটির একটা সভায় এসপ্ল্যানেড এবং কলকাতার আরও কিছু এলাকার কয়েকটা ফটোগ্রাফ দেইখা তো লোকের চক্ষু ছানাবড়া! পরের দিন দি ইংলিশম্যান এন্ড মিলিটারি ক্রনিকল-এর প্রতিবেদনে তো উচ্ছ্বাস যেন আর ধরে না। উল্লেখ করে যে, চৌরঙির একটা ঘর থেইকা তোলা কয়েকটা ছবি খালি চোখে তো নজর কাড়েই, সাথে মাইক্রোস্কোপ দিয়া দেখলে টের পাওন যায় ছবিগুলাতে এমন কিছুর ছাপ ধরা পড়ছে যা এমনি সাধারণ চোখে কোনভাবেই উদ্ধার করা সম্ভব হইত না। বম্বের ফটোগ্রাফিক সোসাইটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (১৮৫৪, ৩ই অক্টোবর) সভাপতির ভাষণে ক্যাপ্টেন হ্যারি বার বলেন, ‘বলার অপেক্ষা রাখেনা… ইন্ডিয়া ফটোগ্রাফারদের জন্য একটা বিশাল ক্ষেত্র মেইলা ধরছে… আমাদের এমন এক শিল্প চর্চায় উদ্দীপ্ত হওন উচিত যা শিব এবং সুন্দর ছাপায়া সত্যের জয়গান হইবে’। সত্য-বস্তুর সন্ধানে এই সংঘের যাত্রাকালে তের সদস্যের মাঝে তিনজন ভারতীয়ও নাম লেখান। যার মধ্যে একজন ডাক্তার বাহু দাজি, ইনি আমাদের আলোচ্য নারায়ণ দাজির বড় দাদা।

যাত্রার পরের বছর, ১৮৫৫ সংঘের একটা সাধারণ সভায়, নারায়ণ দাজির বেশ কয়েকটা আলোকচিত্র হাজেরানে মজলিশের সামনে প্রদর্শিত হয়। তারা বেশ মুগ্ধ হন, দাজির কাজের প্রশংসা করেন। পরে সংঘের জার্নাল উল্লেখ করে বলে যে, ‘এতে বুঝা যায় দেশীয়দের হাতও বেশ পাকাপোক্ত হইছে এবং নতুন এই শিল্পের চর্চায় বেশ উন্নতি সাধন করছে’। এতে বারটার মত ছবি ছিল। তুলনায় বলা যায়, দাজি ইউলিয়ম জনসন বা বেঞ্জামিন সিম্পসনদের চে’ দক্ষতা প্রদর্শনে কোন অংশে কম যান নাই। উনিশ শতকের মধ্যভাগে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল ঘুইরা এগুলা তোলা। এখানে তরুণ নারায়ণ দাজির আধুনিক চোখে ভারতের প্রায় নিশ্চল গ্রাম, অনড় রীতিনীতি আর বিস্তীর্ণ প্রকৃতির মাঝে মানুষের উপস্থিতি পেশা ও বৃত্তির অনুষঙ্গ হইয়া উঠছে। মানুষগুলাকে তার পেশা, পোশাক, সরঞ্জাম ও শরীরের গড়ন থেকে আলাদা কইরা ঠাহর করা প্রায় কষ্টকর ঠেকে। এরা যেন বিভিন্ন অংশে, উপকরণের উপাত্ত হিশাবে অনেক যতœ সহকারে, মেপে মেপে, বাহুল্য ছাড়িয়ে পরিচ্ছন্ন প্রামাণ্য সংগ্রহে সতর্ক আয়োজনে কেটে আনা অংশবিশেষ। তাদের বসার ভঙ্গি কিম্বা দাঁড়ানো, হাত ও পায়ের অবস্থান এমনভাবে সাজানো, হাতিয়ারগুলা এমনভাবে গুঁজে দেয়া, মনে হইতে পারে বুঝি এগুলা ধইরা থাকার জন্যই তাদের ডাক পড়ছে। তারা বেশ শক্ত, ভাবলেশহীন-ভাবে নিজের শরীর যথাসম্ভব যন্ত্রানুসঙ্গের অনুকূলে জড়সড় কইরা রাখছে। হাত পা একটু নড়াচড়া করলে বা শরীর এদিক সেদিক একটু হেলে পড়লে হাতে ধরা বস্তুগুলার জ্যামিতিক ফর্ম, শৃঙ্খলা হুড়মুড় ভাইঙ্গা পড়তে পারে, সেই ভয় যেন তাগোরে তাড়া করতেছে।

 

ঘুম যখন বিরতি

আলাপচারিতা- শহিদুল আলম

মুনেম ওয়াসিফ

 

স্যালন থেকে সোশাল

মুনেম ওয়াসিফ: তো আপনি বিপিএস ছাইড়া দৃক করলেন কেন? আপনি ফটোগ্রাফি নিয়া অন্য কিছু ভাবসিলেন যেইটা বিপিএস এ করা সম্ভব ছিল না?

শহিদুল আলম: বিপিএস নিয়ে আমার কোনই সমস্যা ছিল না। বিপিএস আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। এবং আমি প্রতিষ্ঠানটাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি। যেটা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল যে, বিপিএস এর বাইরেও একটা জগত আছে। যদিও বা আমি এই ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি বা কিছু কিছু মাধ্যমে এই বাইরের জগতের সাথে পরিচিত করার চেষ্টা করেছি, এইটা একটা শৌখিন আলকচিত্রীদের জায়গাই ছিল। পেশাজীবী আলোকচিত্রীদের জায়গা সত্যিকার অর্থে ছিল না। সুন্দর ছবি করা ছিল বিপিএস এর আকর্ষণ, ছবির মাধ্যমে যে একটা কাজ করা সম্ভব সেইটা না। সমাজ পরিবর্তন, ছবির মাধ্যমে একটা আন্দোলন করা, ছবির মাধ্যমে একটা বক্তব্য প্রকাশ করা, ছবির মাধ্যমে প্রতিবাদ করা-এই বিষয়গুলো বিপিএস-এর ছিল না। এটাকে ভাল-খারাপ বলছিনা, বিপিএস এর এই জায়গাটাই ছিল না। এটা একটা দিক। আরেকটা হল, আমি যখন পাশ্চাত্যে বাংলাদেশকে কিভাবে দেখা হয় সেটা দেখি, সেখানে বাংলাদেশকে খুব নেতিবাচক ভাবেই দেখা হত। এখনও অনেক ক্ষেত্রে দেখা হয়। এবং এটা পরিবর্তন করার ব্যাপারে আমাদের কোন ভূমিকাই নেয়া হত না। যদিও বিপিএস সাংবাদিকতা করত না, কিন্তু যেই ক¤পিটিশনগুলো ওরা করত, সেখানে সুন্দর ছবি যেমন যেত, দারিদ্র্যও তেমনি থাকত। কিন্তু জীবন সম্বন্ধে বলার জায়গাগুলি সেভাবে ছিল না। তখন মনে হল স¤পূরক একটা কিছু হওয়া দরকার। বিপিএস গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে, সেটা ঠিক আছে। সেই সাথে স¤পূরক একটা কিছু থাকা দরকার যেখানে আলোকচিত্রটাকে পেশা হিশাবে নেয়া যাবে। যেখানে সত্যিকার অর্থে পেশাজীবীদের জন্য একটা মঞ্চ তৈরি হবে। যেখান থেকে তারা তাদের কাজ দেখাতে পারবে, ছবির একটা ভাষা আসবে, এবং তারা ছবির মাধ্যমে প্রতিবাদও করতে পারবে। সেই রকম চিন্তা থেকেই দৃক শুরু।

 

মুনেম ওয়াসিফ: দৃক এর প্রথম দিকের কিছু ক্যালেন্ডার দেখলে বলা যায় যে আপনি সুন্দর বাংলাদেশের ছবি থেকে আস্তে আস্তে সরে আসছিলেন, যেখানে শ্রেণী বৈষম্য, লিঙ্গীয় অসমতা, নানান রাজনৈতিক অস্থিরতার ছবি উঠে আসছিল। আপনি সোশাল ডকুমেন্টারি বা ফটোজার্নালিস্টিক কাজের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন, যা দিয়ে সমাজকে পরিবর্তন করা যায়? কিন্তু দৃক এর এই সোশাল ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি প্রমোশন ফটোগ্রাফিকে খুব একমুখী করে দিয়েছে? যার ফলে আমরা ৯০’এর দশকে খুব একটা এক্সপেরিমেন্টাল কাজ দেখি নাই। আমি শুধু স্যালন ফটোগ্রাফির কথা বলছি না।

শহিদুল আলম: দৃক যখন শুরু হয় তখন যেই জিনিসটা চেষ্টা করা হয় যে, আমাদের কাজ পৌঁছে দেয়া। তখন শ্রম দেয়া হয় ওই নেটওয়ার্কটা তৈরি করার জন্য। কাঠামো তৈরি করা, আলোকচিত্রীদের একটা ভাল প্রিন্ট করার জায়গার ব্যবস্থা করা। আমরা কিছু কিছু জিনিস করি যা ফটোগ্রাফির সাথে একেবারেই স¤পৃক্ত না, কিন্তু হয়েছিল বলেই এখন ফটোগ্রাফি সম্ভব। আমরা ই-মেইল চালু করি নব্বই দশকের শুরু দিকে। কারণ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা লন্ডন-প্যারিসে থাকব না, বাংলাদেশেই থাকব, কিন্তু আবার তাদের সাথেই আমাদের লড়াই করতে হবে। সেই লড়াইয়ের হাতিয়ারগুলি তৈরি করা। একটা বড় সময় গেছে আমাদের ওই জিনিসগুলি দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে। এবং প্রথম যেই জিনিসগুলি হয়েছে যে দৃকের ক্যালেন্ডারগুলি যখন হয়, তখন দু’টো জিনিস ভিন্ন হয়। তার আগের সকল ক্যালেন্ডার ছিল রঙ্গিন। সাদা-কালো শুধুমাত্র ছাপানো হত বাজেট কম থাকলে। ভাল কাজের জন্যও যে সাদা-কালো হতে পারে, এই বোধ কিন্তু ছিল না। আমরা যখন প্রথম ক্যালেন্ডার করি, সাদা-কালো তো করিই, সেটাকে আমরা আবার স্ক্যান করি। এটা ছিল অদ্ভুত একটা চিন্তা। কারণ সস্তা করার জন্য যেখানে সাদা-কালো করা হয়, প্রসেস ক্যামেরায় সেপারেশন করা হয়, সেখানে স্ক্যানিং-এ গেলে তো রঙ্গিনই করতে পারতাম! এবং আমরা প্রথম ক্যালেন্ডার করি স্ক্যান করে সাদা-কালো এক রঙ্গে। দ্বিতীয় ক্যালেন্ডার করি স্ক্যান করে ডুয়ো-টোন। তৃতীয় ক্যালেন্ডার করি স্ক্যান করে সাদা-কালো ফোর কালারে! এটা তো তখন একটা অদ্ভুত জিনিস! আমি চার রঙ্গেই ছাপাচ্ছি, স্ক্যান করছি, কিন্তু সাদা-কালো ছাপাচ্ছি, ব্যাপারটা কি! এটা বোঝা খুব কঠিন ছিল। এবং তার মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আনার প্রয়োজন ছিল কারণ ক্যালেন্ডার সংস্কৃতির মধ্যে ফুল, সুন্দরী মহিলা, মসজিদ বা ল্যান্ডস্কেপ-এই চারটা বিষয়ের বাইরে ক্যালেন্ডারে কোন বিষয়বস্তু হত না! ক্যালেন্ডারের মধ্যেও যে বিষয় আনা সম্ভব, এবং ক্যালেন্ডার যে সাদা-কালো হতে পারে দু’টোই কিন্তু নতুন একটা ব্যাপার।

মুনেম ওয়াসিফ: আপনি দৃক করার কারণে কি বিপিএস বা পূর্ববর্তী ফটোগ্রাফারদের সাথে কি কোন দূরত্ব তৈরি হয়েছিল?

শহিদুল আলম: দৃককে যখন ভিন্নভাবে দাঁড় করানো হয়, সবাই যে এটা বুঝেছে বা পছন্দ করেছে তা-ও না। কারও কারও হয়ত ধারণা ছিল এটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েকটা জিনিস তো আমরাও করি, যেটা ওরাও করে। যেমন প্রদর্শনী করি, ফটোগ্রাফি ক¤পিটিশন করি, আরও বিভিন্ন ধরনের জিনিস করি। তবে আমরা থেকে থেকেই যৌথভাবে কাজ করেছি। কিছু কিছু জিনিস যেটা আমি মনে করি হয়ত বিপিএস-এরই করা উচিত ছিল, করা হয়নি বলে আমরা করেছি। যেমন, গোলাম কাশেম ড্যাডি এবং মনজুর আলম বেগ এর যৌথ একটা প্রদর্শনী আমাদের এখানে হয়, ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ বলে। এইটা ঠিক যে আমার তখন জায়গা বেশি ছিল, করার সুযোগও বেশি ছিল। তবে শুরুর দিকে দৃক যে ফটোগ্রাফি চর্চার ক্ষেত্রে খুব বেশি ভিন্নতা করেছে তা না। ভিন্ন একটা দিক নিয়ে কাজ করেছে। বিপিএস বিপিএস-এর মতই ছিল এবং সমান্তরালভাবেই কিছুদিন চলেছে। যেটা হয়েছে, যেহেতু আমরা ডকুমেন্টারি কাজ অনেক বেশি করছিলাম তখন ওইদিকে জোর বেশি পড়েছে, অন্যান্য দিক হয়ত তুলনামূলক ভাবে কম হয়েছে। আমাদের আসলে তখন ফটোগ্রাফির প্র্যাকটিস নিয়েও ততটা ব্যস্ততা ছিল না, কাঠামো দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে ছিল।

 

সাদাকালোর রসায়ন

আলাপচারিতা- নাসির আলী মামুন

মুনেম ওয়াসিফ

মুনেম ওয়াসিফ: আচ্ছা তাইলে আপনি প্রথম দিকে, একদম মনে আছে এই যে ধারণাটা আপনার হইল, যে মানুষের চেহারার ছবি তুললে এইটারে পোর্ট্রেট বলে, উপর থেইকা তুললে এইটাকে এরিয়েল ফটোগ্রাফি বলে। প্রথম দিকে আপনি কার পোর্ট্রেট তুলছেন? মানে আপনার বন্ধু-বান্ধব…

নাসির আলী মামুন: আমিতো প্রথম ৬৮/৬৯/৭০ সালের দিকে বন্ধু-বান্ধব, আর ভাই-বোনদের ছবি তুলছি ঘরের মইধ্যে। সেইগুলি অল-মোস্ট স্টুডিওর পাসপোর্ট ছবি মতই আরকি। তাও সেই ছবির মধ্যে আমি খুব চেষ্টা করতাম প্লেইন একটা ওয়ালের সামনে, যেগুলিতে দাগ-টাগ আছে… কিংবা বড় মোটা কোন গাছ, ওরা সবাই ছবি তুলতে চাইত পার্কে গিয়া, রমনা পার্কে যাইতে চাইত, ধানমন্ডি লেকে, যেইটা আমার বাসার থাইকা কাছাকাছি ছিল। এই রকম গেছিও ওদের পীড়াপীড়ির কারণে, ঐখানে গিয়া আমি বড় বড় গাছ খুঁজতাম। বড় বড় গাছের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছবি তুললে, গুড়িটা প্লেন একটা ওয়ালের মত দেখা যাইত, পিছের আমি গাছ-পালা কিছু আনতাম না। তাতে ওরা বিরক্ত হইত। ওরা পছন্দ করত ফুলের সামনে… পরে যখন বি টু সাইজের ছবি প্রিন্ট করতাম, খুব পপুলার একটা সাইজ ছিল তখন, এইটা দীর্ঘদিন, এইটিস পর্যন্ত— ছিল বি টু সাইজ। বি টু সাইজ টা এখনকার যে থ্রি আর সাইজটা আছে, ওটা থেইকা একটু ছোট আরকি। তো ওরা দেখলে বিরক্ত হইত কিন্তু আমার দেখতে খুব ভাল লাগত যে প্লেইন, অন্য ট্র্যাডিশনাল ছবির বাইরে। যে ফুল নাই, নদী নাই, লেক নাই, গাছ-পালা নাই, একটা প্লেন ব্যাকগ্রাউন্ড। তো এই রকম আমি মাথার মধ্যে তখনই আসল যে, মানুষের ছবি একটু আলো-আঁধারই রাখলে কিরকম হয়। তখন লেখকদের বই উলটাইতাম আমি, ফ্লপে যে লেখকের ছবি আমি দেখলাম, আমি তারে তো আমি দেখছি গত সপ্তায়, ওমর অনুষ্ঠানে, সে তো এই রকম না। তাঁর গর্ত আছে, সে কালো, কিন্তু মুখ ফোলা তাঁর, ফর্সা, তাঁর বসন্তে—র দাগ ছিল—দাগ নাই। এইটা কেমন? আমি তখন চিন্তা করলাম, না, এই রকম ছবি তো ছবি না। তখন আস্তে আস্তে আমারও চোখ আমি ঘুরাইলাম, যে মানুষের মুখের মধ্যে যা আছে, ক্ষত বিক্ষত এইগুলা সব আনতে হবে, শুধু তাই না, তার যে হৃদয়ের বেদনা, তার যে আনন্দ, তার যে উচ্ছ্বাস সব ছবির মইধ্যে আনতে হবে। তার কষ্ট ছবির মধ্যে থাকতে হবে, থাকা উচিৎ আমি মনে করি, ঐটাই পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি। এবং তখন আমার মনে হইত যে, ও বলত যে স্টুডিও ফটোগ্রাফি একটা সাইনবোর্ড আমি তখন দেখলাম যে, না আমি ত সাইনবোর্ড পেইন্টার হইতে চাই না। সাইনবোর্ড আঁকাইয়া হইতে চাই না।

 

মুনেম ওয়াসিফ: যেই সময়ের আপনি এই ফটোগ্রাফির প্রতি আপনার আগ্রহ ছিল, তখন কি আপনার কোন কবি, সাহিত্যিক কোন বন্ধু-বান্ধব ছিল? আপনি সিদ্ধান্ত—টা কখন নিলেন, যে আপনি এই বিখ্যাত লোকজন এর পিছন ছুটবেন বা এদের ছবি তুলবেন? কারণ ঐ সময়ে আপনি একদম পেসিফিকলি একটা অন্য জায়গায় ছবি তোলা শুরু করলেন এবং আমি যতদূর জানি সেই অর্থে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, বি পি এস, ঐ গুলার সাথেও আপনি সম্পৃক্ত ছিলেন না। আপনি একদম আলাদা, নিজের মত করে কাজ করে গেছেন…

নাসির আলী মামুন: আমি নিজের মত, নিজের স্বতন্ত্র রাস্তা নির্মাণ করার চেষ্টা করছি। ফটোগ্রাফি লেভেলের কেউ ওই ভাবে, মানুষ বলে না যে আপনার গুরু কে? ঐ রকম আমার কেউ নাই। বরঞ্চ এই পর্যন্ত পদে পদে হোঁচট খাইতে খাইতে… শিয়াল, কুমির, সাপের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইতে হইতে এই চল্লিশ বছর বেয়াল্লিশ বছর হইছে ফটোগ্রাফি কইরা আমি আসছি। সত্য কথা বলি—সফল ফটোগ্রাফার হইছি? না আমি হইতে পারি নাই। তোমাদের ছবি দেখলে আমি বুঝি যে, আমি কত ছোট আমি কত পিছে। আমি কোন জায়গায় আছি? আমি পাঠক তো, তারপরেও আমার কৃতিত্বটা কি? এইটা হইল যে, পুরা জাতিরে, প্রিন্ট মিডিয়ারে এবং প্রকাশনা জগতের চোখ এবং তাদের টেস্ট আমি ঘুরাইছি। ঐ চল্লিশ পাঁচ্চল্লিশ বছর আগের লেখকের ছবি বা আর্টিস্টের ছবি, ছবি না। আমি যে ছবি দিতেছি এইটা হইল তার আসল চেহারা। এইটা তার আত্মা, এইটা তার চেহারা, এইটা তার সিগনেচার, এইটা তার ঠিকানা। অন্তত মিডিয়ার লোকেরা এখন বোঝে, আর প্রকাশনা জগতের এরাও বোঝে। তো এদের এই চোখটা আমি ঘুরাইছি। এইটা নিয়া হয়ত বিশ বছর পর কেউ কাজ করলে করবে, যে আমি এই কাজটা প্রথম করছি বাংলাদেশে। আমি ভাল পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি করি নাই। ঐ প্রথম ফটোগ্রাফি থাইকা এই ফটোগ্রাফিতে আসছে, আনছি। মেকি ফটোগ্রাফি, যেটা স্টুডিও ফটোগ্রাফি—যেইটার মধ্যে কোন শিল্প নাই। শিল্পটা কি? তুমি কইতে পার যে শিল্পটা কি? শিল্পটা হইল যে-পরিষ্কার, স্বচ্ছ পানির মধ্যে তুমি একটা লাঠি ঢুকাইছ, সেই লাঠিটা স্বাভাবিক ভাবে মনে হবে যে সোজা, কিন্তু সোজা নাই। পানির মধ্যে যখন দেখবা লাঠিটা বাঁকা হইয়া গেছে ঐটাই শিল্প। সেইটা করার চেষ্টা করছি কিন্তু আমার পোর্ট্রেট সেই রকম হয় নাই, আমার পোর্ট্রেট পানির মধ্যে দেখা যায় সোজাই আসলে। কিন্তু আমি রাস্তাতো বানাইছি। তোমরা এই রাস্তার মধ্যে পিচ দিয়া রাস্তা ঢালাই করবা, এই রাস্তায় তোমরা এখন গাড়ি চালাইতেছ।

মুনেম ওয়াসিফ: কিন্তু বিখ্যাত মানুষের ছবি তুলতে গেলেন কেন? সদর ঘাটের একটা নৌকার মাঝি, বৃদ্ধ একটা চেহারা তার মুখেও ঐ কষ্ট আছে. আপনি তার ছবি না তুলে শামসুর রাহমানের ছবি তুলতে গেলেন কেন?

নাসির আলী মামুন: তার মুখেও কষ্ট আছে, কিন্তু তার আবার মেধা নাই। আমি হইলাম চিরকাল মেধাবী মানুষদের পূজারী এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল মানুষ। কবি, সাহিত্যিক, লেখক, অর্থনীতিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিবিদ, সংগীত শিল্পী, পেইন্টার, আমি সব সময় এদের আচরণে, এদের কথা বার্তায়, জীবন যাপনে এবং এদের কাজ-কর্মেতে অভিভূত হইতাম। সবসময় ফ্যাসিনেটেড, এখনও হই। বিস্ময় ভাবে হই। যেমন যেকোনো মানুষ, বিখ্যাত মানুষকে দেখলেই আমি তাকে প্রথমে এমন একটা পর্যায়ে নিয়া যাই, মানুষের সাথে আলোচনা করতে গেলে, যে সে ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রেটি। না হইলেও আমি কথায় প্রমাণ করার চেষ্টা করি যে, সে ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রেটি। কাজেই আমি এমন একটা ক্যারিসমেটিক জগত নিজের মধ্যে তৈরি করছিলাম যে, ঐটা আমার ব্লাডের মধ্যেই মিশা গেছিল, বিখ্যাত লোক ছাড়া আর কিছু বুঝি না আমি। আর আমার পরিবারের মধ্যে একজন ছিল খুব নামকরা কবি, ছোট বেলা থেইকা তাকেও আমি দেখতাম। তাঁর জীবন-যাপন এই রকম পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে, খালি গাঁয়ে থাকে, লুঙ্গি পইড়া ঘুরতাছে। জসীম উদদ্দিন এর কথা কইতেছি। দেখলাম যে তাঁর সৃষ্টি কর্ম এই রকম, সারা বাংলাদেশের লোক পড়ে, বাংলা সাহিত্যের সবাই পড়ে। পিএইচডি করতাছে, ইউরোপ-আমেরিকায় তাঁর বই নিয়া কাজ হইতাছে, অনুবাদ হইতাছে। আমিতো এদের উপরেই কাজ করব। ছোট বেলায় মনে হইত আর কি। পরে যখন বাহাত্তর সালে আমি ক্যামেরা হাতে নিলাম প্রথম, আমার নিজস্ব^ কোন ক্যামেরা ছিল না। ধার করা ক্যামেরা, তখন আমি কাজে লাগাইলাম-এইসব মানুষদের যে ইমেজ আমার মধ্যে রইছে, সৃষ্টিশীল মানুষ এদের উপর কাজ করব, পোর্ট্রেট করব। এদের দুঃখ, বেদনা এগুলোর উপর কাজ করব।

মুনেম ওয়াসিফ: ধরেন রিচার্ড অ্যাভেডন, হেনরি কিসিজ্ঞারেরও ছবি তুলছে আবার মেরলিন মনরোর ছবি তুলছে। কিন্তু আপনার ছবি দেখলে আমি যেমন দেখি, আপনি খালি অ্যালেন গিনসবার্গ-এর মত মানুষের ছবি তুলছেন। আপনার ছবিতে বিখ্যাত মানুষদের ভিতরে আপনার একটা সিলেকশন আছে। আইদার তারা খুব রুচিবান, অথবা সত্যিকার অর্থেই তারা খুব ইন্টেলেকচুয়াল অথবা তারা আপনার অর্থে ভাল মানুষ। ধরেন খারাপ মানুষও তো বিখ্যাত হয়, আপনে তো সুইডেন আসলামের ছবি তোলেন নাই। তার মানে আপনার এই ভাল মানুষের মধ্যে একটা সিলেকশন আছে। এইটা কি আপনে মনে করেন আপনার ব্যক্তিগত রুচির জায়গা থেইকা তৈরি হইছে?

নাসির আলী মামুন: আচ্ছা, সত্যি বলি, প্রথমত আমার কাছে যারা গুরুত্বপূর্ণ তাদের পোর্ট্রেটই আমি করি। এখন তোমার মনে হইতে পারে… যে বিখ্যাতর কোন সংজ্ঞা নাই। আজকে যে বিখ্যাত, দশ বছর পরে সে দেখা গেল একদম বিখ্যাতই না। আবার আজকে যে বিখ্যাত না তারে হয়ত আমি রিকোগনাইজ করতে পারলাম না। যে রকম আরজ আলী মাতুব্বররে আমরা চিনি নাই। কত ঘুরত বাংলা একাডেমীতে, ন্যাশনাল বুক সেন্টারে ঘুরত, কেউ পাত্তা দিত না। পান খাইত, চা খাইত আর গল্প করত, কেউ চিনে নাই, আমিও তো চিনি নাই, আমিও দেখছি, আমিও তার ছবি তুলি নাই।

মুনেম ওয়াসিফ: সেই অর্থে বলি নাই মামুন ভাই। আমি বললাম যে, আপনার মানুষ চেনার ধরনটা বুঝতে চাই কারণ আমি দেখছি যে আপনি অনেক এরকম লোকের ছবি তুলছেন যারা এখনও বিখ্যাত হয় নাই, কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন, যে এই লোক মেধাবী এবং এই লোক হয়ত কিছু একটা হবে। এবং আপনি অনেক আগেই তার ছবি তুলছেন।

নাসির আলী মামুন: না, এইটা বোঝা যায়, যেমন আমার মনের মধ্যে একটা রাডার আছে ঐটা বুঝতে পারে যে, টোকা দিলে যেরকম কলসি বাজে না? এইটা বোঝা যায় যে, কার মধ্যে মেধা আছে। এই রকম আমি ভুল করছি শতকরা দুই জন। বহু মানুষের যেমন-রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, এই লেভেলের ছবি তুলছি ওরা যখন কবি হয় নাই, বই প্রকাশ পায় নাই, সেভেন্টিজে এদের ছবি তুলছি। পরে আমি দেখছি যে, ম্যাক্সিমাম এদের বেশির ভাগই কিন্তু উৎরাইয়া গেছে। তারা সৃষ্টিশীল হইছে, দেশে নাম করছে, ভাল কাজও করছে। ৫০টা ১০০টা বইও অনেকের আছে, আমি তাদের ছবি তুলি নাই, এমন বহুলোক আছে। আমারে ফোন করে, ঘুরে ছবি তোলার জন্য এমন বহু লোক আছে। তুলি না ছবি।

 

 

ঘোলাটে ছবির আখ্যান

তানজিম ওয়াহাব

 

স্যালন  ফটোগ্রাফির আলোচনায় স্যালন  পেইন্টিং থেকেই ঘুরে আসতে হবে। প্যারিসে ১৭২৫ সালে স্যালন’’র প্রচলন ঘটে যখন ফরাসি সরকার শিল্পমান যাচাই আর শিল্পপ্রদর্শনী আয়োজনের লক্ষে তৈরি করে এক একাডেমি একাদেমি দে ব্যু আর্ট)। একাডেমি স্বীকৃত না হলে কারো ছবি প্রদর্শন হতো না, যার সিদ্ধান্ত নিত শুধুমাত্র সরকার নির্ধারিত বাক্তিবর্গ। তাদের পছন্দের তালিকায় ছিল বাইবেলীয় আখ্যান , পৌরাণিক বিষয়বস্ত যা শিল্পীর কল্পনাশক্তি নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করে বটে, তবে তা বাস্তবতা বিবর্জিত। চিত্রকলার ইমপ্রেসনিজম আন্দোলনের সময় এই ধারার প্যারিস স্যালনের সাথে ইম্প্রেসনিস্ট শিল্পীদের সরাসরি সংঘাত ঘটে। প্যারিস স্যালনের শিল্পের একক সংজ্ঞায়ন তারা নাকচ করে দেয়। যেমন ধরুন শিল্পে নগ্নতা নিয়ে প্যারিস স্যালনের ভাষ্য। তাদের ভষ্য মানুষের নগ্নতা (বিশেষ করে নারীর) শিল্পে শুধুমাত্র উত্তীর্ণ হতে পারে যখন তা আবেদনময়, কিন্তু নেংটো উপস্থাপন হল শিল্পবিমুখ অশ্লীলতা। ইংরেজিতে ন্যুড আর নেকেড এর সংজ্ঞায়ন জটিলতা বলতে পারেন। বুঝেন ঠ্যালা? ইমপ্রেসনিস্ট আর রিয়েলিস্ট শিল্পীরা প্রতিবাদস্বরূপ রীতিমত ব্যাঙ্গ করা শুরু করল। রিয়েলিস্ট পেইন্টার অনরে দোমিয়ের সেইসময়ের অসংখ্য ক্যারিকেচার স্যালন পেইন্টিংকে ব্যাঙ্গ করে বুর্জোয়া শিল্পচর্চা হিসেবে।

বিতর্ক শুরু হলেও  স্যালন  পেইন্টিং তার নির্দিষ্ট চরিত্রেই অনড় থাকে- অতি নান্দনিক, কাল্পনিক দৃশ্যায়ন, আলোছায়ার নাটকীয়তা আর সুন্দর, মঙ্গলময় জীবনের গুণকীর্তন। । কেন হঠাৎ স্যালন পেইন্টিং নিয়ে বললাম?

নিঃসঙ্গ প্রকৃতির রূপকার

ডঃ নওয়াজেশ আহমেদ

আলাপচারিতা: নাসির আলী মামুন

 

নওয়াজেশ আহমেদ: তখন আমার সঙ্গে ছিলেন বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। উনিও একজন মেম্বার ছিলেন। আমাকে বলছিলো, আপনি কলকাতায় যান। কলকাতায় গিয়ে আরো কিছু ছবি বেছে নিয়ে এসে এটা করেন। আমি একটা অজুহাত দেখালাম যে কলকাতা যেতে পারবো না। না গিয়ে বুদ্ধি করে এখানে দু’’টো পার্ট করলাম। একটা স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের ওপর, বাকিটা রূপসী বাংলা, ‘হে বাংলা আমার। কার জন্য যুদ্ধ?’ এই বাংলার জন্যই তো, যে জন্য আমাকে প্রচুর বিরোধিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিলো। কেউ ছবি দিতে চাচ্ছিলো না।  অ্যানি ওয়ে, আমি বলবো যে  আমাদের ওই এক্সিবিশনটা খুবই সাকসেসফুল, সত্যিকারের উন্নতমানের একটা জাতীয় প্রদর্শনী হয়েছিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচুর ছবি ছিলো, আরেকদিকে গ্রাম বাংলার ছবি। আমরা বলেছিলাম যে যদি এই পোরশনটা না দেখাই, তবে আমাদের আলোকচিত্র স্থান পাবে না। বঙ্গবন্ধু আসলেন, দেখলেন, খুবই খুশী হলেন এবং বললেন যে, ‘তোরা আর কি কি করতেছস?’ যেহেতু আর্ট কলেজের মধ্যে হচ্ছিলো, ওখানে আর্ট কলেজের প্রিন্সিপালও ছিলেন। তখন প্রিন্সিপাল ছিলেন জয়নুল আবেদীন। তাকে আমি বললাম, তিনি বললেন যে, ‘হ্যাঁ, এটা তো ভালো কথা। এটা তো আমাদের অনেক আগেকার আইডিয়া ছিলো’। বললেন, ‘নায়েবউদ্দীনকে ডাক দেন। কারণ তার কতগুলি প্রিয় লোক ছিলো। আমানুল হককে একটু ডাকেন’।

আমি এদেরকে ডেকেছিলাম। আমানুল হক সাহেব অসুস্থ থাকায় আসেননি। নায়েবউদ্দীন সাহেব, আমি, কিছু প্রেস ফটোগ্রাফার ছিলাম। সব মিলে বলা হলো আবেদীন সাহেবকে, ‘আপনি যেটা করতে পারেন’। আমাকে বললো, যেহেতু আমি বহু দেশ ঘুরে এসব আর্ট ইন্সটিটিউট দেখেছি। আমাকে বললেন, ‘আপনি কোন জায়গায় কি দেখেছেন বলেন’। আমি বললাম, স্পেশালাইজড হয় দুই বছর। সিনেমাটোগ্রাফি এখন না, কারণ এটা একটু হেভি। কিন্তু স্টিল ফটোগ্রাফি করা যেতে পারে। উনি রাজি হলেন। তারপর ’৭৫ এসে গেলো। গন্ডগোল হলো। আমিও দেশ ছেড়ে কাজে গেলাম। পরবর্তীতে জিনিসটা ভাটার মধ্যে চলে গেলো। কিন্তু আলোকচিত্রীদের মধ্যে একটা দল বললো যে, তারা আর্ট কলেজের সঙ্গে না রেখে নিজস্ব একটা ইন্সটিটিউট করবে। আমার মনে হয় সেটা একটা ফ্যাক্টর।

নাসির আলী মামুন: এই দলে কারা ছিল?

নওয়াজেশ আহমেদ: আমি ঠিক জানি না। আমি তখন দেশের বাইরে। শুনলাম। আর্ট কলেজের কাইয়ুম চৌধুরী, যারা গ্রাফিক্স নিয়ে কাজ করে তারা খুব ইন্টেরেস্টেড ছিলো। তারা আমাকে বললো যে ফটোগ্রাফাররা তো অন্য কথা বলে…..

ফটোগ্রাফি উইদাউট ক্যামেরা!

বিজন সরকার

আলাপচারিতা: মুনেম ওয়াসিফ

মুনেম ওয়াসিফ: তো, আপনার একভাই তো সাইনবোর্ড ব্যানার এসব আঁকতেন, আরেক ভাই কী করতেন?

বিজন সরকার: সে-ও এই কাজই করতেন। যেহেতু তাঁরা তিন বছরের বড়-ছোট ছিলো, তো ন্যাচারালি ফ্রেন্ডসও হয়েছে সেরকম । আর আমি বড় ভাইয়ের তের বছরের ছোট। বিরাট একটা গ্যাপ রয়েছে। গ্যাপের জন্যই বোধহয় আমার ভাইয়ের প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসা ছিলো, আবার বিস্ময়করও ছিলো যে উনি বহু কাজ করতেন। বহু কাজ করতো বলতে এইটা মনে হয় প্রতিভাবানদের ব্যাপারে কথাটা হল জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ পর্যন্ত একটা কথা আছে মানে যা পায় তাই করে এরকম আর কি! সে একসময় কম্পাউন্ডারিও করসে।

মুনেম ওয়াসিফ: তো, সে এরকম নানান কাজে পারদর্শী ছিলো?

বিজন সরকার: নানান কাজে। মানে, আমি যতদূর জানি আর কি! দোকানের হিসাব রাখার কাজ করত, আবার কম্পাউন্ডারিও করতো। বিভিন্ন লেখালেখি এইসবের মধ্যে ছিলো। সে ছবি আঁকাতে যখন আরেকটু বেশি দিন কাটালো, অনেক কিছু করলো, তখন সে মূর্তি বানানো শুরু করলো। প্রতিমা-স্বরস্বতী, লক্ষ্মী এগুলো। স্বরস্বতী পূজা তো আমাদের ব্যাপকভাবে প্রচলন আছে। তো মূর্তি বানানোর ক্ষেত্রেও অনেকরকম জ্ঞান দরকার। আমি ছোটবেলায় দেখেছি, যে মাটিটা ছানতো, ঐ মাটির ভেতরে আগে পাট কেটে দিতো, পরে আবার ধানের তুষ মেশাচ্ছে। আমি বলি ‘এগুলা দিলে কেন?’ ও বলে ‘এইটা আরো ছোট অংশে মাটি ধরে রাখে’, এইরকম আরো কি সব বললো যেটা মনে নাই। উনার এক আর্টিস্ট ফ্রেন্ড ছিলো কলকাতায়। উনাদের যে কাজ-কাম বা বিচরণ সবই কলকাতা ভিত্তিক আর কি। সেই কারণে পাকিস্তান যখন আলাদা  হলো তখন উনি আসামে ছিলেন। উনি এই ধরনের নানান সৃজনশীল কাজের মধ্যেই ব্যাপ্ত ছিলেন… যেহেতু ভাইয়ের অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছি, তাই কিছুটা বলতেই হবে। উনি বোধহয় ফোরটি ফাইভ এর দিকে, কিংবা ফোরটি ফোর এর দিকে হতে পারে, মিনিট ক্যামেরা ব্যবহার করতেন। পেপার নেগেটিভ।

মুনেম ওয়াসিফ: কিন্তু আপনি প্রথম ক্যামেরা হাতে পাইলেন কবে বা শুরু করলেন কবে?

বিজন সরকার: এই অনুপ্রেরণাটার প্রয়োজন আছে, সেইজন্যই বলি। এর মাঝখানের পিরিয়ডে, বড় ভাই কথা-বার্তা বলতো ছোটভাইয়ের সাথে। আমার সঙ্গে না, আমি তো তখন কথা বলার অযোগ্য। দশ বছরের ডিফারেন্স, আমার সঙ্গে কী কথা বলবে? মেঝ ভাইকে বলতো, লাইটিং সম্বন্ধে। তারপর একটা ভেরি ইম্পোর্ট্যান্ট কথা বলেছে। নাচে বা গানে পুরস্কার পেয়েছে, এটা নিয়ে বলছেন যে কোন বিচারক বিচার করেছে, সে কি বোঝে এই কাজ? কিংবা এরাই বা কার কাছে দেয় বিচার করার জন্য? কোনো শিল্প কোনোদিন বিচার করার অধিকার কারো নাই। ওই কথাগুলো বলছে। শিল্প তো হচ্ছে সাধনার বিষয়, এটা সারাজীবন শুধু সাধনা করে যেতে হয়। এর মাধ্যমেই যাবতীয় উত্তরণ হয়। কী অদ্ভুত কথা না?

মুনেম ওয়াসিফ: অনেক মূল্যবান কথা।

বিজন সরকার: অনেক মূল্যবান কথা না? এটা ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা। ভাই তো আমাকে পাত্তাই দেবে না, এই কথা শোনাবে? ‘এই ভাগ, ডিস্টার্ব করিস না’, এই কথা বলতো আর কি! কিন্তু এই কথা ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি। তারপর লাইটিং সম্বন্ধে বলত, কোথায় কোন লাইটিং। ধরেন, এখানে বসলে ডান দিকের যে লাইটিংটা আসবে, এই লাইটেই এইদিকে মুখটা ঘোরালে পরে দুই মুখেই আসবে। এদিকটা শেড, এইদিকটায়। এইসব কথা আমি তখনই বুঝতে পারতাম। তারপরে খোলা জায়গায় বারান্দায় একটা ঘর আছে, তার চাল নেই। তার সামনে যদি দুই-তিন হাত উপরে দিয়ে একটা কালো কাপড় মাথার ওপর দিয়ে দেয়া হয়, তাহলে পাসপোর্ট ছবি খুব ভালো আসবে। লাইট দুই দিকে যদি সমান থাকে তাহলে একরকম লাইট হবে, একদিক যদি বেশী থাকে থাকে তাইলে হালকা লাইট অ্যান্ড শেড হবে। চমৎকার কথা না? এইগুলা তো আমি জ্ঞান হওয়ার আগেই শিখেছি। বড় ভাই বলতো এইগুলো।

মুনেম ওয়াসিফ: তখন আপনার বয়স কত হবে? ৭-৮-১০ বছর? স্কুল-টিস্কুলে পড়েন তখন?

বিজন সরকার: বয়স হবে… পাকিস্তান যখন হয়, ৪৭-এ, তখন আমি ১২ বছর। হিসাবটা আসলে…

মুনেম ওয়াসিফ: আচ্ছা বয়স গুরুত্বপূর্ণ না, আপনি গল্পটা বলতে থাকেন, যে কথাগুলো শুনছেন সেই সময়।

বিজন সরকার: এই জিনিসগুলা আমি পরে বুঝলাম যে আমার যে অনেক ক্রিয়েটিভ জ্ঞান আসছে, এইটা নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ের কারণে। এইরকম আরো অনেক কথা আমি আমার ভাইয়ের কাছে শুনেছি। সব মনেও নাই। কিন্তু ভাইয়ের কারণে আমার এই ক্রিয়েটিভ জ্ঞানটা হইসে। আমি এখন মনে করি অই যে আপনি আমার ওই ছবির ইন্টারভিউ নিতে চেয়েছেন, ঐটা আমি আর দিতে চাই না। চাই না এইজন্যে, যে কাজ আমি ষাটের দশকে করেছি, সেই কাজ আজও বাংলাদেশের কোনো ফটোগ্রাফার জানে না। ঔৎসুক্যও কেউ প্রকাশ করে নি। তাইলে আমি কি মনে করবো?…