ডকুমেন্টরিঃ প্রামানিকতা ও বিবিধার্থ

অলিভার লুগন
অনুবাদ
ওয়াহিদ সুজন ও সম্পাদনা পর্ষদ

আমরা যদি আজও ডকুমেন্টারির মত একটা নিত্য পরিবর্তনশীল ধারণার অর্থ ভালভাবে বুঝতে চাই, দুর্ভাগ্যের বিষয় তাতে পিছনে ফিরার প্রয়োজন পড়ে খুব সামান্যই। সময়ান্তরে ডকুমেন্টরি কথাটার অর্থ নানান রূপ এবং ভঙ্গি অদল বদলের মধ্যে দিয়ে গেছে। ফলত, পরস্পর বিরোধী সংজ্ঞাও পয়দা হয়েছে। ডকুমেন্টরি ধারণাটির অসঙ্গতি এর নিজস্ব ইতিহাসের কোন শেকড়ে জড়িয়ে আছেÑ অতীতে পুনর্দৃষ্টি কেবল তার হদিসটুকু উন্মোচিত করবে। ডকুমেন্টরি অভিধাটি আদতে কি অর্থ ব্যক্ত করে সে বিষয়ে আজও কেউ নিশ্চয় জ্ঞান হাসেল করতে পারে নাই ফিল্মের কথা টানলে, আপাত একটা সংজ্ঞা পয়দা করা সম্ভবÑ মোটা দাগে যা কিছু ফিকশন নয় তাই ডকুমেন্টরি। কিন্তু ফটোগ্রাফিতে ডকুমেন্টরির বিপরীতে এমনতর কিছু দেখানো কঠিন, কেননা ফটোগ্রাফির মধ্যে কোন জিনিসকে আমরা ফিকশন বলে আলাদা করে দেখাব? কাজেই ডকুমেন্টরি অভিধাটির প্রকৃত পরিসর নির্ধারণের মুশকিলটাও এখানেই নিহিত। সে যাইহোক, অর্থবোধকটার এই অস্পষ্টতা চলার পথে বিশেষ বাধা হয়ে দাঁড়ায় নাই; বরং এর সাফল্য এবং ছড়িয়ে পড়ায় সহায়ক বনেছে, জগত জুড়ে নানান কিসিমের নির্মাতারা নিজের কাজটাকে এই তকমায় মুড়িয়ে চালিয়ে দিয়েছে, মানুষের কাছে ফেরি করেছে। গত প্রায় এক শতক জুড়ে ডকুমেন্টরির প্রভাব-প্রতিপত্তির বড় কারণ রয়েছে অভিধাটি দেদারসে ব্যবহারের এই অবাধ স্বাধীনতায়।

অবশ্য, অজস্র সংজ্ঞার এতসব অস্পষ্টতার মাঝেও এমন একটা উপাদানের সাধারণ উপস্থিতি ও ঐক্যসূত্র পাওয়া যাবে যা কোনকিছুকে ডকুমেন্টরি বলে আখ্যা দিতে চাইলে একান্তই আবশ্যিক। এটা হল ডকুমেন্টরির অন্তর্গত বাসনা, ডকুমেন্টরি চায়Ñ‘জগত-সংসারে যা কিছু যেভাবে আছে’Ñসে অবস্থার উন্মোচন, বিষয়বস্তুর গ্রহণযোগ্য ও প্রামাণিক তথ্য সরবরাহ; বাস্তবতার শুদ্ধ নিরলঙ্কার চরিত্র অক্ষুণ্ণœ রাখতে বাড়তি নান্দনিকতা পরিহার। এই সাধারণ ঐক্যমত্যের পরে সর্বত্রই দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা শুরু হয়। সেটা হতে পারে কিভাবে একটা বিষয়ের বর্ণনা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে সেই প্রশ্ন, কিম্বা বেছে নেয়া বিষয়বস্তুর যথার্থতা বা জড়ো করা সাধারণ উপাদানগুলো ব্যবহারের ধরন নির্ধারণ নিয়ে। সে যাইহোক, ভিন্নতা ও বিতর্ক সত্ত্বেও ডকুমেন্টরির তিনটা পথই খোলা আছে সেটা পরিষ্কার— এনসাইক্লোপিডিক বা শিক্ষামূলক ধারা, ঐতিহ্য-সংরক্ষণ-বাদী ধারা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ধারা। এই তিনটি ধারার নান্দনিক রীতিনীতির দিকটাও বিবেচনা করা যেতে পারে; সে দিকে আমরা পরে প্রবেশ করব।

বিশ শতকের প্রথম দশকে শিক্ষামূলক এবং সংরক্ষণ-বাদী এই দুটি ধারা ডকুমেন্টরি শব্দটির শোভা বর্ধন করেছে। একই সময়ে ফরাসি দেশে ‘ফিল্ম ডকুমেন্টিয়ারে’ বলতে নির্দেশ করত ভ্রমণ বা সংস্কৃতি বিষয়ক শিক্ষামূলক ফিল্ম। ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে, প্রাথমিক তর্কগুলো চালু ছিল এনসাইক্লোপিডিক আর্কাইভিং ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মজুদ করণের মধ্যে। অবশ্য, ইতিমধ্যে সমাজ সংস্কারক এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো ফটোগ্রাফিকে কাজে লাগানো শুরু করেছে, নানা বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে, শহরের দারিদ্র্য ও শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে সরব হতে। যদিও ছবির এই যুদ্ধংদেহী উদ্দেশ্যের ব্যবহার প্রথমদিকে ডকুমেন্টরি সংশ্লিষ্ট ছিলনা। উনিশ শতকের ত্রিশের দশক পর্যন্ত এর সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল পুরোভাগে একচ্ছত্র জায়গা নিয়ে এবং যা এখনও সমান মাত্রায় জারি আছে। পরিভাষাটির শব্দার্থিক পরিবর্তন এসেছে প্রধানত অ্যাংলো-স্যাক্সন প্রভাবে। বস্তুত, দুই মহাযুদ্ধের সময়কালে আমেরিকা ও ব্রিটিশ লেখকরা ফরাসি ডকুমেন্টয়ারে শব্দটি এস্তেমাল করে। তারা প্রথমে সিনেমায় এবং পরে ফটোগ্রাফিতে ‘ডকুমেন্টায়ার’ কথাটা আনে। স্টেজ না করে তোলা সাক্ষাৎ দুনিয়ার ছবি এবং সামাজিক বাস্তবতা উপস্থাপনের কাজগুলো বুঝাতে এর সাধারণ ব্যবহার ঘটে। এইভাবে ডকুমেন্টরি অভিধাটি সত্যের তালাশ কিম্বা ঘটনার বিবরণ সন্ধানে জোরালো নৈতিক এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধ আশ্রয়ী ব্যঞ্জনা অর্জন করে। ইংরেজির মারফত ঘটা এই অবস্থান্তর ও নৈতিক মূল্য যোগকে শুকরিয়া জানাতে হয়। একইসাথে তা নান্দনিক আলোচনারও সূচনা করে অতঃপর ইউরোপে ফেরত আসে। তবে, সর্বজনস্বীকৃত-ভাবেই আমেরিকানদের চেয়ে জর্মান ও ফ্রান্সেই এর ব্যঞ্জনা ব্যাপকতা লাভ করেছে।

ঘটনা যাই হোক, এর অন্যান্য ব্যাখ্যাগুলোও কখনও সম্পূর্ণভাবে চুপসে যায় নাই, এমনকি অ্যাংলো-স্যাক্সন টেক্সট থেকেও না। ধাঁধার মত মনে হলেও, জিগা ভারটভকে প্রথম দিককার ব্রিটিশ তাত্ত্বিক জন গিয়ারসন এবং পল রুথা, ডকুমেন্টরির জনক হিশাবে সাব্যস্ত করেন নাই। বরং তারা নির্বাচন করলেন খুবই গতানুগতিক ধারার রোমান্টিক ও অতীতকাতর গবেষক রবার্ট ফ্লাহেট্রিকে। একইভাবে ফটোগ্রাফিতে জনকের মর্যাদা পেলেন পুরাতন দলিল দস্তাবেজের মোহাফেজকার ইউজেন আঁজে, ফ্লাহেট্রির মত ইনিও ছিলেন অতীতচারী। ‘ডকুমেন্টরি ঐতিহ্যের’ সিলসিলায় ত্রিশ দশক থেকে আঁজে পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণদের মধ্যে ছিলেন— হেনরি লি সেকউ, ম্যাথিউ ব্রাডি, জ্যাকব রিস, লুইস হাইন, পল স্ট্যান্ড, ওয়াকার ইভান্স, ডরথিয়া ল্যাঙ ও ফার্ম সিকিউরিটি এডমিনিস্ট্রেশন প্রমুখ। দেখা যাবে এদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলটাই প্রকট। এসব রেকর্ড কর্মে যেমন নাই বিধিবদ্ধটা, তেমনি নাই কোন যৌক্তিক শৃঙ্খলা। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় আঁজের সংরক্ষণ-বাদী দৃষ্টিভঙ্গি (ফটোগ্রাফি কোনকিছুকে জীবিত রাখে) এবং হাইনের সমাজ সংস্কারের বাসনা (ফটোগ্রাফি পরিবর্তন আনে) আর ইভান্সের আক্ষরিক অনুকৃতির মাঝে মূলত সম্পর্কটা কোথায়?
বাস্তবতার বিশ্বস্ত উপস্থাপনের ধরণ থেকেই পদ্ধতিগত পার্থক্য বড়সড় হয়ে আবির্ভূত হয়। নির্মাতার কি উচিত হবে বিষয়ের আপাত নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে অন্তরালে লীন হয়ে থাকা, অথবা প্রামাণ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য কি তার উপস্থিতি অপরিহার্য? নান্দনিক বিধিবদ্ধটা কাম্য নাকি সেটা বরং তিরষ্কারযোগ্য?

প্রামাণ্য আলোকচিত্রের ভেতর বাহির, অতঃপর

মার্থা রসলার
অনুবাদ
এস এম মনিরুজ্জামান ও সম্পাদনা পর্ষদ

আমরা যদি আজও ডকুমেন্টারির মত একটা নিত্য পরিবর্তনশীল ধারণার অর্থ ভালভাবে বুঝতে চাই, দুর্ভাগ্যের বিষয় তাতে পিছনে ফিরার প্রয়োজন পড়ে খুব সামান্যই। সময়ান্তরে ডকুমেন্টরি কথাটার অর্থ নানান রূপ এবং ভঙ্গি অদল বদলের মধ্যে দিয়ে গেছে। ফলত, পরস্পর বিরোধী সংজ্ঞাও পয়দা হয়েছে। ডকুমেন্টরি ধারণাটির অসঙ্গতি এর নিজস্ব ইতিহাসের কোন শেকড়ে জড়িয়ে আছেÑ অতীতে পুনর্দৃষ্টি কেবল তার হদিসটুকু উন্মোচিত করবে। ডকুমেন্টরি অভিধাটি আদতে কি অর্থ ব্যক্ত করে সে বিষয়ে আজও কেউ নিশ্চয় জ্ঞান হাসেল করতে পারে নাই ফিল্মের কথা টানলে, আপাত একটা সংজ্ঞা পয়দা করা সম্ভবÑ মোটা দাগে যা কিছু ফিকশন নয় তাই ডকুমেন্টরি। কিন্তু ফটোগ্রাফিতে ডকুমেন্টরির বিপরীতে এমনতর কিছু দেখানো কঠিন, কেননা ফটোগ্রাফির মধ্যে কোন জিনিসকে আমরা ফিকশন বলে আলাদা করে দেখাব? কাজেই ডকুমেন্টরি অভিধাটির প্রকৃত পরিসর নির্ধারণের মুশকিলটাও এখানেই নিহিত। সে যাইহোক, অর্থবোধকটার এই অস্পষ্টতা চলার পথে বিশেষ বাধা হয়ে দাঁড়ায় নাই; বরং এর সাফল্য এবং ছড়িয়ে পড়ায় সহায়ক বনেছে, জগত জুড়ে নানান কিসিমের নির্মাতারা নিজের কাজটাকে এই তকমায় মুড়িয়ে চালিয়ে দিয়েছে, মানুষের কাছে ফেরি করেছে। গত প্রায় এক শতক জুড়ে ডকুমেন্টরির প্রভাব-প্রতিপত্তির বড় কারণ রয়েছে অভিধাটি দেদারসে ব্যবহারের এই অবাধ স্বাধীনতায়।

 

…একটি ছবিতে দেখা যায় ফ্রান্সের গ্রামের ছায়াঘন বীথিকা (দু’ ধারে গাছের সারি অলা রাস্তা) দিয়ে এক লোক আর এক পিচ্চি কালো গোল ক্যাপ পরে একটি বাইসাইকেলে চড়ে যাচ্ছে— সাইকেলের পেছনে ঝুলছে একটি রুটির ব্যাগ। এই ছবিটাই আমি বছর-খানেক আগে দেখছি। ডয়েল ডেইন বার্নবাখ বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্য এলিয়ট এরউইট পঞ্চাশের দশকে ছবিটা তুলছিলেন। এলিয়ট ছবিটির জন্য ১৫০০ ডলার পেয়েছেন। ছবিটি লাগেনি’। তাহলে আলোকচিত্রও কি সভ্যতার মতই, শোষণের উপর ভিত গেড়ে দণ্ডায়মান? আমি জবাবে বলেছিলাম, ‘ইন দিস প্রাউড ল্যান্ড’ নামক বইয়ে ল্যাঙের টুকে রাখা নোট থেকে উদ্ধৃতি উল্লেখ করছে যে, ‘তিনি (থমসন) ভেবেছিলেন যে, আমার তোলা ছবি তাকে সাহায্য করতে পারে এবং এই ভেবে তিনি আমাকে ছবি তুলতে দিয়েছিলেন’। আমার বন্ধু লেবার ফটোগ্রাফার পাল্টা জবাবে বলেন: ‘আলোকচিত্রটির প্রকাশনার ফলশ্রুতিতে স্থানীয় কর্মকর্তারা অভিবাসীদের ক্যা¤েপর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। তাতে মিসেস থমসন সরাসরি উপকার না পেলেও অন্যরা পেয়েছে। মিসেস থমসন ব্যাপারটি ভুল বুঝেছেন’। তার এই জবাব শুনে ফটোগ্রাফির গভীরে বসত করা একটা ফাটল আমার কাছে পরিষ্কার হল। একটি ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফির দুটো মুহূর্ত ধরা পড়েঃ প্রথমটি তাৎক্ষণিক, কেজো উদ্দেশ্য পূরণ করে। যেখানে বাস্তবতার নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা থেকে একটা অংশ তুলে আনা হয় বা তৈরি করা হয় প্রতিনিধিত্ব শীল সাক্ষ্য হিশাবে। একেবারে আইনি অর্থে প্রামাণ্যের দাবি নিয়ে কোন সামাজিক প্রথার পক্ষে বা বিপক্ষে আদর্শিক বা তাত্ত্বিক সমর্থন জ্ঞাপন করে। দ্বিতীয়টি প্রথাগত ‘নান্দনিক- ঐতিহাসিক’। এইখানে চৌহদ্দিটা অনেক আলগা। সামাজিক ভূমিকা গৌণ, নান্দনিকতাই মুখ্য। অর্থাৎ একটি আলোকচিত্র দর্শকের চিন্তা উসকালো কি না তা বিবেচ্য নয়। দর্শকের দিলের মাঝে নান্দনিক আনন্দের হিল্লোল বয়ে দিতে পারল কিনা সেটাই সাফল্যের পরিচায়ক। সেটাই একটা ছবি কতটা সুসংগঠিত হয়েছে তা বিচারের মাপকাঠি। অর্থের কোন ঐতিহাসিক নির্দিষ্টতা না মানা আসলে অনৈতিহাসিক অবস্থান গ্রহণের নামান্তর। কিন্তু সময়ের দিক থেকে ছবিটি যে অতীতের গর্ভে নির্মিত সে বিষয়ে আবার তা ‘ইতিহাস মনষ্কতা’ বজায় রাখে। ছবির ব্যাখ্যা বা রাজনৈতিক ও রূপকার্থের মধ্যে দাণ্ডিক স¤পর্ক অস্বীকার করে গোপন অর্থ আবিষ্কার করার এই প্রবণতাটি সত্যিই বিপজ্জনক। এই মার্গের সাধুরা মনে করে শিল্প তথা আলোকচিত্রের সুনির্দিষ্ট বাধন সূত্র আলগা হলে কিংবা সময়ান্তরে তা আবছা হয়ে আসলে বরং সারবত্তা সমঝানো সহজ হয়। কারণ তখন এর নান্দনিক রূপ প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। (যদিও আবার সামাজিক মনোভাব নামক অস্পষ্টতার কুশনে পেতে রাখে যাতে শেষে ছবি রহস্যময়টায় খাবি না খায়।) আমার দাবি মতাদর্শ নিরপেক্ষ নন্দনতত্ত্ব বলে কিছু নাই। ইমেজের প্রতি আমাদের সম্পর্কের যেকোনো ধরনই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি জাত, আরও খাস করে বললে সাংস্কৃতিক উৎপাদনের সামাজিক বোঝাপড়ার ভিতরে নিহিত। (ডরথির প্রকাশিত মন্তব্য ধর্তব্যে নিলে এমনই মনে হয় যে, তিনি এই সামাজিক বোঝাপড়া সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, কিন্তু সাংস্কৃতিক আত্মীয়করণের প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে অনেক আগেই কাজটি এই পরিপ্রেক্ষিত হারিয়ে বসেছে।)

বাস্তবে আলোকচিত্র চর্চার ক্ষেত্রে এরকম ধারণা প্রয়োগের সমস্যা হল, এটা ভুলে যায় যে, সঠিক নন্দন তাত্ত্বিক ভাবনারও বদল ঘটে। কারণ এটা এই সত্য এড়িয়ে যায় যে, নির্দিষ্ট বৈষয়িক বাস্তবতা ছাপিয়ে যেতে সক্ষম অর্থের বিভিন্নতা নয় বরং ঐতিহাসিক স্বার্থই কোন রূপ বা কাঠামো অর্থ প্রকাশে পর্যাপ্ত কিনা তা নিয়ন্ত্রণ করে। সবচে বড় কথা ইতিহাস আপনাকে দুই বার আন্দাজ করার সুযোগ দেয় না। আলোকচিত্রের প্রথাসিদ্ধ (ষবমরঃরসধঃব) ইতিহাসে জেকোভ রিসের পাশাপাশি লুইস হাইন, আর্থার ফেলিগের সাথে জানি লিওন যে, একত্রিত হয়েছে তার হেতু নান্দনিক অভিযোজনগত স্বভাবে। স্পষ্টতই ডরথি ও লেবার ফটোগ্রাফার-এর মত যারা কাঁচা ইন্দ্রিয়কে অর্থ সঞ্চারের শক্তিশালী উপায় সমঝেছেন তারা ধ্রুপদী সৌন্দর্যতত্ত্বের অপরিসীম মতাদর্শিক শক্তির বিরুদ্ধতা করছিলেন। এই ধ্রুপদী সৌন্দর্যতত্ত্ব মতে সর্বজনীন রূপের সন্ধানে নেমে দুনিয়া থেকে আমরা কেবলমাত্র শ্বাশত নান্দনিকতার আভাস পেতে পারি।

বর্তমানে শিল্পকর্ম মাত্রেই প্রেক্ষিত বিচ্ছিন্ন করে দেখার যে, সাংস্কৃতিক ধুন্দমার চলছে তার ফলে এই বিষয়টি অনুধাবন প্রকারান্তর অসম্ভব। বিশেষত, ল্যাঙ এবং লেবার ফটোগ্রাফারের মত যারা তারা এবং তাদের কাজকে কার্যত অবমূল্যায়নই করা হয়। কাজের সাথে আলোকচিত্রীর নিজের যে সম্পর্কটা আমার মনে হয় আমি তা ভিতর থেকে বুঝি। সত্যিকার অর্থে তাদের অনুমিত স্বেচ্ছাধীনটা বলতে বুঝায় নিজের সমগ্র কাজের ভিতরে ঐ বিশেষ ছবির অবস্থান এবং ফটোগ্রাফির দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ততা। কিন্তু আমি একইসাথে আত্মরক্ষামূলক এই জোরাজুরি দেখলে ধৈর্য ধরতে পারি না। এটা এমনকি যে কারও মহৎ উদ্দেশ্যকেও শেষমেশ শোষকের হাতে হাতিয়ার বানায়।

যৌন নির্ভরতার উপাখ্যান

ন্যান গোল্ডিন
অনুবাদ
তাসলিমা আখ্তার
এটা এখনও আমার পরিবার

দশ বছর পার হল ব্যালাড বেরিয়েছে এবং সত্যিই আমি আর বইটির দিকে ফিরে তাকাইনি। ওটা তখনকার বিষয় ছিল; আর এখন এটা এই সময়ের। আমার লিখিত এবং আলোকচিত্রের দুই ধরনের ডায়েরির কাজই আমি অব্যাহত রেখেছি। আমার জন্যে এগুলো অতীতের দেখভালের কাজ করে, আর বর্তমানে আমাকে পরিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করার সুযোগ করে দেয়। আমি এই বইতে ছবিগুলো রেখেছিলাম যাতে করে নস্টালজিয়া কখনও আমার অতীতকে বর্ণিল করতে না পারে। আমি টের পাই আমার নিজের জখম হবার ছবিগুলো আমি তুলেছিলাম যাতে আমাকে যে মেরেছিল সে মানুষটির কাছে আমি আর কখনও ফিরে না যাই।

আমি আমার জীবনের রেকর্ড রাখতে চেয়েছিলাম যাতে কেউ কখনও এতে রং চড়াতে না পারেঃ কোন নিরাপদ কিংবা পরিচ্ছন্ন বয়ান নয়, বরং চেয়েছি আসলেই যা ঘটেছিল এবং অনুভূত হয়েছিল তারই একটা রেকর্ড রাখতে। তবে আমি যা ভেবেছিলাম আলোকচিত্র ততটা কার্যকর ভাবে স্মৃতি ধরে রাখতে পারে না। এই বইয়ের অনেক মানুষই এখন মৃত, বেশিরভাগই ছিল এইডসে আক্রান্ত। আমি ভেবেছিলাম এই হারানোর বেদনা আমি আলোকচিত্রের মাধ্যমে দূরে সরিয়ে রাখতে পারব। আমি সবসময় ভেবেছি কারও কিংবা কোনকিছুর ছবি যদি আমি যথেষ্ট পরিমাণ তুলে রাখি, তাহলে আমি কখনওই সেই ব্যক্তিকে হারাব না, হারাব না সেই স্মৃতি, হারাব না সেই জায়গা। কিন্তু ছবিগুলোই দেখিয়ে দিচ্ছে আমি কতটা পরিমাণে হারিয়েছি। এইডস সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। সেইসব মানুষ যারা আমাকে সবচেয়ে ভালভাবে চিনত, বুঝত, সেইসব মানুষ যারা আমার ইতিহাস বহন করেছে, যাদের সাথে আমি বেড়ে উঠেছিলাম এবং যাদের সাথে একসাথে বৃদ্ধ হবার কথা ভেবেছি তারা সবাই চলে গেছে। খুব অল্প সময়েই আমাদের ইতিহাস কাটা পড়ে গেছে।

চারপাশের মানুষজনকে হারানোর ফলে নিজেকে হারানোরই একটা অনুভূতি হয়। কিন্তু একইসাথে ঐ বৃহত্তর পরিবারটা এখনও চলছে এই অনুভূতিও কাজ করে। এইডস সব দিক থেকেই আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। নিজ পরিমণ্ডলের মানুষগুলো যখন মারা যাচ্ছিল, নিজেকে ধ্বংস করার মহিমা পরিণত হয় একটা বেয়াড়া প্রশ্রয়ে: আত্ম-ধ্বংসী শিল্পীদের যে রোমান্টিক কল্পনা, দুর্ভোগ কিংবা যন্ত্রণা ছাড়া সৃষ্টিশীল কাজ হয় না, সৃষ্টিশীলতা ভীষণ ভালোলাগার এক অনুভূতি কিংবা চরম অতিরিক্ততা থেকেই আসেÑ এসব ভাবনা পাল্টে যায়। আমাদের জীবনে মৃত্যুর উপস্থিতি বেঁচে থাকার একটা সত্যিকার ইচ্ছা, বাঁচার জন্যে পরস্পরকে সাহায্য করা, পরস্পরের কাছে হাজির থাকার একটা ইচ্ছা নিয়ে এসেছিল। শুরুতে ড্রাগস সব কিছু তুঙ্গে তোলার বিষয় ছিল, শেষে সেটাই পরিণত হল শেকলে। আমি ড্রাগস নিতাম মূলত অনেক বেশি স্বপ্ন দেখার, অনেক বেশি স্বচ্ছতা পাবার জন্য, নিজের ভেতরের সব ধরনের বাধা ডিঙ্গানো, পরিপূর্ণভাবে স্বতঃস্ফূর্ত এবং বন্য হয়ে ওঠার জন্য। অনেক দিন এটা কাজও করেছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এটা চালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন ছিল। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যকার সময়ে যখন আমি ব্যবহারের সীমা ছেড়ে অপব্যবহারের দিকে চলে গিয়েছিলাম তখন আমার জগত ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

১৯৮৮ সালে ব্যালাড এর প্রথম প্রকাশের দু বছর পর, আমি ড্রাগস এবং এলকোহল ছাড়ার জন্য একটা ক্লিনিকে ভর্তি হই। ব্যালাড এর একটা কপি আমি আমার সাথে নিয়েছিলাম। অন্য রোগীদের ড্রাগস এবং যৌনতা বিষয়ে আগ্রহ তৈরির কারণ হতে পারেÑএই বলে নার্সরা প্রথমেই বইটি নিয়ে নিল। হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় দু মাস আমি আমার কাজ দেখার অনুমতি পাইনি, এমনকি আমার ক্যামেরা ধরারও। কিশোর বেলার পর এই প্রথমবারের মত আমি আমার বোঝাপড়া এবং অভিজ্ঞতা বাঁচিয়ে রাখার যে মাধ্যম ছবি তোলা, সেটা করতে সক্ষম হইনি। আমার মনে হয় ড্রাগস থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ায় ক্যামেরা হাতে না থাকাটা আমার বিক্ষুব্ধটাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। হাসপাতালের চৌহদ্দিতে আমি যখন চিকিৎসার মাঝামাঝি পর্যায়ে ঢুকলাম; আমাকে আমার ক্যামেরা ফেরত দেওয়া হল। আমি সেলফ পোর্ট্রেট’র (আত্ম-প্রতিকৃতির) একটি সিরিজ শুরু করি যেটা আমার শীঘ্রই সেরে উঠার ক্ষেত্রে নির্ধারক হয়ে ওঠে। প্রতিদিন নিজের ছবি তোলার মধ্য দিয়ে আমি নিজেকে খুঁজে পেতে নিজের অবয়ব ফিরে পেতে সক্ষম হই। ওই সময়েই আমি ডে-লাইট (দিনের আলো) বিষয়টাও আবিষ্কার করি, এর আগে ফটোগ্রাফী যে আলোর সাথে সম্পর্কিত আমি এটা জানতামই না। আমি সবসময়েই ভাবতাম এভেইলেবেল লাইট (স্বাভাবিক আলো) বলতে বোঝায় শেষরাতের বারের লাল বাল্বের আলো।

ফলে এই নতুন কাজ—ড্রাগস ছাড়া আমার প্রথম ছবিগুলো আক্ষরিক এবং রূপক দুদিক থেকেই অন্ধকার থেকে আলোতে আসার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সেই থেকে এ পর্যন্ত আমি যত কাজ করেছি ওইটাই ছিল যাত্রা বিন্দু। এখন আমার ছবিগুলো অনেক বেশি নিজের সাথে বোঝাপড়ার, নির্ঝঞ্ঝাট, আগের মত বাড়াবাড়ি আচরণের বিষয় নয়, যদিও সবকিছুর পরও আছে সীমাকে অতিক্রমের আকাঙ্ক্ষা। ছবিগুলোর মাঝের শক্তি এখন অন্যরকম, অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট, অনেক বেশি স্বচ্ছ। এখানে আলো আছে এবং অন্ধকার আছে, আছে এই দুয়ের মাঝেরও যা কিছু। ফটোগ্রাফি আমার জন্য হয়ে পড়েছে মুক্তির দিশা। এটা আমার অধোগতিকে বুঝতে এবং আমার পুনর্গঠনে সাহায্য করেছে।

আমার চারপাশের মানুষজনের ছবি এখনও আমি তুলছি। ব্যালাডেরও অনেক চরিত্র যেমন ডেভিড, ব্র“স, গ্রীয়ার, কীডথ, শ্যারন, ভিভিয়েন এবং তার ন’ বছর বয়সী ছেলে ওরাও আমার ছবিতে আছে। ফলে শিশুদের মধ্য দিয়ে এর মাঝে একটি ধারাবাহিকতাও থাকছে। আমার বন্ধুদের পরিবার এখনও পারস্পরিক নির্ভরতা, ধারাবাহিকতা, ভালবাসা এবং মমত্ববোধের ওপর ভর করে আছে। আমার বন্ধু এবং প্রেমিকদের মাঝে আমি কোন আবেগীয় দূরত্ব তৈরি করি না। আমি বিশ্বাস করি না আলোকচিত্র সময়কে থামিয়ে দেয়। আমি এখনও আলোকচিত্রের সত্যতায় বিশ্বাস করি যা আমাকে এই সময়ে সেকেলে করে তুলেছে। আমি এখনও বিশ্বাস করি ছবি জীবনকে নির্জীব না করে বরং বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ব্যালাডের ছবিগুলো বদলায়নি। কিন্তু কুকি আর নেই, কেনি নেই, মার্ক নেই, ম্যাক্স নেই, ভিট্টোরিও আর নেই। আর তাই আমার কাছে এই বইটি এক বিরাট হারানোর বেদনা সংকলন একইসাথে ভালবাসারও উপাখ্যান।

ন্যান গোল্ডিন, মার্চ ১৯৯৬

জোড়াতালিতে মার্টিন পার

অনুবাদ
প্রজ্ঞা তাসনুভা রুবাইয়াত

.
প্রশ্ন: আপনি একজন ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফার, অথচ আপনাকে বাণিজ্যিক কাজের ব্যাপারেও অনুৎসাহী বলে মনে হয় না।

মার্টিন পার: না, একেবারেই না! ফটোগ্রাফি আসলেই একটা বাণিজ্যিক কাজ। এমনকি হাই আর্ট ফটোগ্রাফিও এইটার বাইরে না, তারাও প্রিন্ট বিক্রি করতে চায়! আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, এখন যদি আপনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ফটোগ্রাফারের কথা ভাবেন, দেখবেন যে সেইটা ফ্যাশন ফটোগ্রাফার স্টিভেন মিজেল না, আন্দ্রে[?] গার্স্কি, যিনি কিন্তু এখন আর্ট মার্কেটে সবার উপরে আছেন। মজার ব্যাপার হল যে আর্ট মার্কেটকে অর্থনৈতিক ভাবে অধিকাংশ সময়েই, বাণিজ্যের দরিদ্র ভাই হিশাবে দেখা হয়, সেটাই এখন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকেও অনেক দূর ছাড়িয়ে গেছে! আপনি যে কোন ফটোগ্রাফারকে জিজ্ঞেস করে দেখেন সে কি করতে চায়, দেখবেন তারা হয়ত বলবেঃ আমি আমার নিজের মত কাজ করতে চাই, আমি আমার কাজ প্রিন্ট হিশাবে বেচতে চাই। আলটিমেটলি, এইটা কিন্তু একটা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যই। সুতরাং, আমরা কখন্ওই এই বাণিজ্যিক ব্যাপার স্যাপার থেকে দূরে থাকতে পারব না।

 

প্রশ্ন: কিন্তু, শিল্পের ওপর অর্থনীতি যে কর্তৃত্ব করছে, আপনার কি মনে হয় না এইটা প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে আপনি এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন?

মার্টিন পার: কেন প্রত্যাখ্যান করতে চান, আমি সেটার কোন কারণ দেখি না। বাণিজ্যই কিন্তু সব ঘটনা ঘটাইতেছে। যদি জনসংখ্যার এক শতাংশের কথা ধরে বলা যায়, তবে তাদের কেউই সরকারি ভর্তুকি পাওয়া ঘেট্টোতে বসবাস করতে রাজি হবে না। ফটোগ্রাফিরই সেই ক্ষমতা আছে যে সে একইসাথে গণতান্ত্রিক, বাছ বিচারহীন, এমনকি মানুষের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্যও হতে পারে। যদি আপনার ঘেট্টো’র বাইরে বের হয়ে আসতে হয়, তাহলে আপনাকে বাণিজ্যিক বৃত্তের মধ্যে ঢুকতেই হবে। এই যে ফ্যাশন জগতের মানুষগুলা, বিজ্ঞাপন, পোস্টার, বিলবোর্ড এইগুলোতে আর কি। আর এইগুলাও আসলে আরেক ধরনের ঘেট্টো। এই দলটা আকারে একটু বড় আর কি। আপনি এইটাও বলতে পারেন যে, ভিজ্যুয়াল কালচারটাও একটা ঘেট্টো, কিন্তু আমাদের অবস্থান এইটার ভিতরেই। আপনি যদি পশ্চিমা দুনিয়াতে থাকেন, দেখবেন সেইখানে কেউই এইটার বাইরে না। আমাদের দুনিয়ার চারপাশ চিত্র দিয়ে ঘেরা, সেইটা অ্যাডভার্টাইজিংই হোক, আর ফ্যামিলি স্ন্যাপশটই হোক। মাথায় রাখা দরকার সবাই কিন্তু এখন ফটোগ্রাফার। এইটা অবশ্যই ফটোগ্রাফির একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক। আর, সবসময়ই এর দর্শক বাড়া দরকার আর লোকজন যখন ফটোগ্রাফির ব্যবহার শুরুই করে, তখন এর মাঝে একটু বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করলে খারাপ কি!

প্রশ্ন: এইসব ‘ইমেজ ফ্লো’ এর বেশিরভাগই তো খুব গতানুগতিক, আপনি প্রায়ই এই বিষয়ে প্রপাগান্ডা শব্দটা ব্যবহার করেন। একটু ভেঙে বলবেন, এইটা দিয়ে আপনি কি বোঝাতে চান?

মার্টিন পার: যেসব ইমেজ আমরা দেখি তার বেশির ভাগই এক ধরনের প্রপাগান্ডা, কারণ প্রতিটা ইমেজেরই একটা এজেন্ডা থাকে। বিজ্ঞাপনী কিংবা বাণিজ্যিক জগতের ক্ষেত্রে কেবল বিক্রি হওয়াটাই ফটোগ্রাফির একমাত্র উপযোগিতা, যদিও সকল ফটোগ্রাফিরই একটা এজেন্ডা থাকে। অথবা ফ্যামিলি স্ন্যাপশটের ক্ষেত্রে বিষয়টা হল একটা ‘পারফেক্ট ফ্যামিলির’ ধারণা বিক্রি করা। আমি এইটা বলছি না যে, ইনডিপেন্ডেন্ট ফটোগ্রাফারদের কোন এজেন্ডা নাই, কারণ নিশ্চিতভাবে তাদেরও একটা এজেন্ডা থাকেঃ আপনি দুইজন ফটোগ্রাফারকে একই শহরে পাঠিয়ে দেখতে পারেন, দেখবেন তারা দুইজনই একে অপরের থেকে একদমই ভিন্ন কাজ নিয়ে আসবে। দেখা যাবে একজনের কাজ হবে খুবই ইতিবাচক, আরেকজনেরটা হবে একেবারেই নেতিবাচক।

প্রশ্ন: অনেক শিল্পীই ইদানিং ফটোগ্রাফিকে একটা কনসেপচুয়াল মিডিয়াম হিশাবে ব্যবহার করেনঃ বোঝাই যায় যে, তারা ছবিটার ব্যাপারে আগ্রহী এবং সেই ছবির প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু তারা সেই ছবির গঠন কিংবা কৌশলগত বিষয়ে খুব দৃঢ়ভাবে আগ্রহী হননা, এমনকি ফটোগ্রাফির ইতিহাস এবং সেখানে তাদের অবস্থানের ব্যাপারেও না। একটু আগেই আপনি বললেন, ছবি তোলাটা এখন খুব সহজ, সেটাও একটা কারণ। আপনি কি খেয়াল করেছেন, কিংবা ভেবেছেন যখন ফটোগ্রাফি শিল্প জগতের সাথে মিশে গেছে, তখনই কিছু একটা পরিবর্তন ঘটেছে?
মার্টিন পার: নিশ্চিতভাবে। এখন যেভাবে আপনারা ফটোগ্রাফিকে দেখেন, তাতে একটা বিশাল পরিবর্তন ঘটে গেছে। দশ বছর আগেও টেট গ্যালারি ফটোগ্রাফ কিনত না, যদি না সেটা একজন শিল্পীর করা হত, কিন্তু এখন তারা অন্যান্য লোকজনের কাছ থেকে ছবি কেনে এমনকি আমার মত লোকের কাছ থেকেও। এইটা তাদের পরিচালনা নীতির বিশাল পরিবর্তন। এখন যদি আপনি একটা আর্ট ফেয়ারে যান, এক তৃতীয়াংশ ছবিই হল ফটোগ্রাফি।

প্রশ্ন: ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফারদের লক্ষ্য কিভাবে পরিবর্তন হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?

মার্টিন পার: লাইফ ম্যাগাজিন কিংবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর কালার সাপ্লিমেন্টগুলোর মত প্রচলিত যেসব ফটোজার্নালিস্টিক পত্রিকাগুলো ছিল এগুলোর কাটতি ক্রমশ পড়তির দিকে। ফলে আপনি যদি একজন ফটোজার্নালিস্ট হন (মনে রাখবেন আমি কিন্তু একজন ফটোজার্নালিস্ট না), আপনাকে অনেক পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। আপনার সামনে এগোনোর জন্য দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে। আর আপনার যদি শক্তিশালী কাজ থাকে তাহলে বিশ্বাস রাখতে হবে যে কিছু মানুষ আছে যারা আপনার ছবি ছাপাবে। কিন্তু আপনার কমিশন পাওয়া এবং পত্রিকার কাজ ছাপানো তার থেকে অনেক কঠিন। সে জন্যই ম্যাগনামের মত এজেন্সিগুলো বেশ ভাল করছে কারণ তারা এটা বুঝতে পারছে যে, ফটোগ্রাফির ভবিষ্যৎ শুধু পত্রিকার পাতায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটার সাথে মিউজিয়াম কিংবা ভ্রাম্যমান প্রদর্শনীর মত অন্যান্য কালচারাল ভেন্যুও যুক্ত হবে।

সংকলনমুনেম ওয়াসিফ ও তানজিম ওয়াহাব

 

 

হালের আমজনতা এবং ফটোগ্রাফি

শার্ল বোদলেয়ার

অনুবাদ: ইমরান ফিরদাউস

 

আমি বলতে চাইছি ঐসব আর্টিস্টদের কথা যারা দর্শকদের তাক লাগাতে পছন্দ করেন। তাক লাগানোর বাসনা ও চমকে যাবার ক্ষমতা উভয়ই নিয়মসম্মত। তবে ‘বিস্মিত হওয়ার’ সুখ যেমন আছে তেমনি ‘স্বপ্নকাতরতাও সুখের’। তুমি যদি আমা হতে শিল্পী অথবা শিল্পরসিকের তকমা পাবার জন্য গোঁ ধরে থাকো, তবে আমার প্রশ্ন হলো: কি উপায়ে নিজের কোনো  সৃষ্টিতে বিস্ময়ের উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে চাও বা কি দ্বারা বিস্মিত  অনুভব কর? সুন্দর মাত্রেই বিস্মিত করে, তাই বলে বিস্মিত করার উপাদান থাকলেই সেটা সুন্দর হয়ে যাবে না। এখন, ফরাসী জনগণের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, তাদের সংকীর্ণ হৃদয় স্বপ্ন দেখা বা মুগ্ধতার আনন্দ ধারনে একান্তই অক্ষম। সকলে বরং চায় পিলে চমকানো শিহরণ, হোক তা শিল্পের সাথে সাযুজ্যহীন কোনো উপায়। আর তাদের বাধ্যগত শিল্পীগণ, জন-রুচির কাছে নতজানু হয়ে থাকেন; তাদের লক্ষ্য বরাবরই দৃষ্টি আকর্ষণ করা, চমকে দেয়া এবং কুৎসিত কৌশলে বেকুব বানানো, কারণ, তারা পরিস্কার জানে পাবলিকের প্রকৃত শিল্প হতে পরমানন্দ উপভোগের ক্ষমতা নাই।

এই শোচনীয় কালে আরেকটি নতুন ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ ঘটেছে যার দরুন  পাবলিকের  বেকুবি বিশ্বাস আরো পোক্ত হল। তাতে করে ফরাসি মনের যা কিছু নিবু নিবু দিব্য-আলো অবশিষ্ট ছিল এবার তাও নিবতে বসল।  স্বাভাবিকভাবেই আকৃতি পূজার বাড়বাড়ন্ত এমন একটা আদর্শে আরাধনা করছিল যাতে নিজস্ব প্রকৃতিরও বিগ্রহ স্থাপন করা যায়।  এই মুহুর্তে বিশেষ করে ফরাসি দেশে পেইন্টিংস ও খোদাইশিল্পের ক্ষেত্রে প্রচলিত শিল্প-বিশ্বাস হলো (এর বিপরীতে কারও কিছু বলার স্পর্ধা আছে বলে আমি  বিশ্বাস করি না) ‘আমি প্রকৃতির ভজনা করি এবং প্রকৃতির অকৃত্রিম পূজারি’ (এর কিছু ভালো কারণও আছে)। ‘আমি বিশ্বাস করি আর্ট শুধু মাত্র তাই যা প্রকৃতির অবিকল পুনরুৎপাদন করে মাত্র’ (একদল ভীরু সম্প্রদায়, স্বাভাবিক ভাবে অস্বস্তিকর বস্তু সমূহকে ছবি থেকে বাদ দিতে চান, যেমন, শয়নকক্ষে ব্যবহার্য মূত্রধানী অথবা মানব কংকাল)’। ‘যদি একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রক্রিয়া, প্রকৃতির অবিকল  ছবি তুলতে পারে, তবে সেটিই হবে পরম শিল্প’ তো, এইসব কথা একদা এক প্রতিহিংসাপরায়ণ খোদার কানে পৌঁছুলে তিনি দাগুয়েখ নাম্নী চিত্রকর-রসায়নবিদ কে ইমাম মাহাদি করে তাদের উদ্দেশ্যে পাঠান। তখন তারা নিজদেরকে বলল, ‘যেহেতু ফটোগ্রাফি আমাদের নির্ভুলতার পরিপূর্ণ গ্যারান্টি দিচ্ছে (তারা তা সত্যিই বিশ্বাস করল, হায়রে পাগল! ) তাই আলোকচিত্রই হচ্ছে শিল্প’। আর ঐ মুহূর্তে থেকে আমাদের জঘন্য সমাজ  নার্সিসাসের মতন  ছুটে গেল ঐ মেটালিক প্লেটের প্রতি যা নিতান্ত মামুলি ছবি ধারণকরে। এক প্রকার বিকারগ্রস্থতা, অন্ধ উন্মত্ততা, এই নয়া সূর্য উপাসকদের অধিকার করে নেয়। একধরণের কদর্যতা তাদের মাঝে ফুটে উঠে। জনা কয়েক ইতর নারী-পুরুষ এক জায়গায় জড়ো করে ধোপা/কসাইয়ের সাজ-পোশাকে  ফটো খিঁচে তারা ভাবছে আহা প্রাচীন সমাজের আনন্দ-বেদনার ছবি তুলে ফেললাম।

আলোকচিত্রের আধুলি কথন

ভাল্টার বেনিয়ামিন

অনুবাদ: মুসতাইন জহির

 

…শিল্প নবিশীর অভিজ্ঞতার জন্য নয় বরং নতুন কায়দা রপ্তকরণে সিদ্ধহস্ত হবার উপরেই আলোকচিত্রে তাদের যাবতীয় মুনশিয়ানা দিতে হয়। ক্রমে এই মধ্যম প্রজন্ম কালের অতলে মিলায়া যায়। মনে হয় যেন আদিপুস্তক বাইবেল কথিত বিশেষ কৃপাধন্য হইয়া নাদার, স্টেলজনার, পিয়ারসন, বেয়ার্ড প্রভৃতি সবাই বয়সের কোটা আশি কি নব্বই ছুঁইতে পারছে। যদিও শেষতক, সবদিকের লোকেরা পেশাদারি আলোকচিত্রের ব্যবসায় ঢুইকা পড়ে। যখন নেগেটিভ বাড়তি ঘষামাজা কইরা ছবি বাইর করার ধুম লাগে, তখন বাজে চিত্রকরদের পোয়াবারো হয় আলোকচিত্রের উপর প্রতিশোধ নেয়ার। চটজলদি উনা রুচি দশদিক দখল করতে থাকে। এসময়ই আলোকচিত্রের এ্যালবামের চল শুরু হয়। বাসাবাড়ির ঠাণ্ডা জায়গায়, সাজানো টেবিলে, বসবার ঘরে তখন ছবির এ্যালবাম দৃষ্টিগ্রাহ্য কইরা রাখা হইত। চামড়া দিয়া বাঁধাই করা চকচকে ধাতব পাতের ফ্রেমে: অ্যালেক্স চাচা কিম্বা রিখি খালা, ট্রুডি যখন পিচ্চি ছিল, বাবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছর, ইত্যাকার ছবিতে ভইরা থাকত। শেষমেশ নিজের দুষ্টামিভরা কিছু দৃশ্য না থাকলে ওটা যেন সম্পূর্ণ হইত না। এই যেমন: নরসুন্দরের মত চুল কাটার অঙ্গভঙ্গি, হাত-পা নাইড়া হেড়ে গলায় গান, আগুনের ফুলকি আঁকা কোন ছবির কাছে আগুন নেভানোর ভঙ্গিতে হ্যাট নাড়ানো, ভারিক্কি চালে নাবিক সুলভ কেতা, কিম্বা এক পায়ে ঠেস দিয়া খাড়ানোর বিশেষ কোনো ভঙ্গিমা।

এইসব পোট্রেট-এ কোন খুটিঁ বা স্তম্ভ কিংবা ডিম্বাকৃতির টেবিল জাতীয় উপকরণাদি ব্যবহার করা হইত যাতে ঠেস দেয়া যায়। ওটা এক্সপোজারকালীন লম্বা সময়টাতে মডেলের সটান রাখার দরকারের কথাই মনে করাবে। মাথা কিংবা হাঁটু সোজা রাখতে ব্যবহৃত উপকরণাদি পয়লা পয়লা যথেষ্ট মনে হইলেও পরে তা বিখ্যাত চিত্রকলার অনুকরণে ফ্রেমে আরো সব শৈল্পিক উপাদান যুক্ত করে মানুষজনের চাহিদা তৃপ্ত করার পথ ধরে। এরই হাত ধইরা আসে কলাম এবং পর্দা। অবশ্য সমঝদাররা সেই ষাটের দশকেই তাতে আপত্তি তোলে। পেশাদার এক ইংরাজি জার্নালে প্রশ্ন তোলা হয়: ‘চিত্রকলার মধ্যে কলাম না হয় বুঝা গেল, কিন্তু আলোকচিত্রে যেভাবে এটা ঢুকানো হইছে তাতে তো কিম্ভূতকিমাকার ধারণ করছে। সাধারণত দেখা যায় মডেল কার্পেটের উপরই দণ্ডায়মান। তো, মার্বেল বা পাথরের কলাম কার্পেটের উপর ভিত গাইড়া মাথা তুইলা আছে এটা কারো পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব?’ এটা ছিল সেইসব স্টুডিওর জমানা যেখানে ঝালর শোভিত পাম গাছ, কারুকাজময় সজ্জা এবং ক্যানভাস ঝুলিয়ে রাখার ফ্রেম ইত্যাকার নানাবিধ উপকরণে ভর্তি কক্ষটা যেন ছবির উপস্থাপন বা ফাঁসির বেদি, নির্যাতন কক্ষ বা রাজাসনের মত দ্বিবিধ চরিত্র নিয়া দ্বিধাগ্রস্ত হ’য়া থাকত। কাফকার প্রথমদিকার একটা পোট্রেট যার সরস নজির হ’য়া আছে। সম্ভবত বছর ছয়েকের একটা বাচ্চা, খুবই আটোসাটো বিব্রতকর একটা স্যুট পরে শীতকালের কোনো বাগানে দাঁড়ায়া আছে। পিছনে পামগাছের পাতাগুলা যেন ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে আছে। যেন ঐসব আদ্দিকালের রদ্দিমার্কা জিনিসে ঠাসা পরিবেশটাকে আরো গুমোট করে তুলতে বেমানান একটা বড়সড় হ্যাট (এ ধরনের হ্যাট স্প্যানিশরা পরে) বাম হাতে নিয়া খাড়ায়া আছে। আমরা আশপাশের এতসব কিছুর ভিতরেই হারায়া যাইতাম যদি না তার নিঃসীম বিমর্ষ চোখগুলা আর সব ছাপায়ে জায়গা কইরা নিবার প্রাণপণ আকুতিতে ভর্তি না থাকত।

অসীম বেদনার ভেলায় ভাসানো ছবিটা পয়লা জমানার সব আলোকচিত্রের প্রতিমূর্তি বনছে মনে লয়…

আলোকচিত্রের চোখে দেখা

এডওয়ার্ড ওয়েস্টন

অনুবাদ: সাইফুল হক অমি

মূলত এই ভুল ধারণা আতঙ্কজনক সব অনাসৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াল। অদ্ভুত পোশাকের ব্যবহার থেকে শুরু করে অর্থহীন আউট অফ ফোকাস—এ সবকিছুই করা হয়েছিলো শিল্পের দোহাই পেড়ে।

আলোকচিত্র উল্টা পথে চলার পেছনে এইটাই একমাত্র কারণ নয়। আসল সংকট তৈরি হয়  ভ্রান্তসব মানদণ্ড খাঁড়া করার মধ্যে।  চিত্রকলার অনুরূপ ফটো-পেইন্টিং  তৈরি করা আলোকচিত্রির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল।  আলোকচিত্র মাধ্যমের নিজস্ব প্রকৃতি বিরোধী একেবারে বেখাপ্পা চর্চায় নিয়োজিত থাকল ফটো-পেইন্টাররা। পরিণতিতে, আলোকচিত্র মাধ্যমের প্রতিটা গুণগত বিকাশ সেই সব অবিমৃশ্যকারীদের সামনে একেকটা বাঁধা তৈরি করল। আলোকচিত্র যে বিপুল সৃষ্টিশীল সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছিল, চিত্রকলাবাদী ধারার প্রভাব  স্বীকৃতি লাভের সেই সময়টা অনেক পিছিয়ে দেয়। দৃশ্যজগত উন্মোচনের নতুন উপায় হাতে পেয়ে যাদের আবিষ্কারে মনোযোগী হবার কথা তারাই বরং সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন মাধ্যমটির নিহিত সম্ভাবনা। আর চিত্রকলার মত করে আলোকচিত্র সৃষ্টির ভুত চাপে তাদের মাথায়, যা  ক্রমাগত আলোকচিত্রের সব মূল্যচেতনা থেকে মৌলিকভাবে তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে  ।

ফলাফল দাঁড়াল, যখন আমরা অতীতের সেরা কাজগুলোর হিসেব নিতে বসি তখন আমাদের প্রায়শঃ তাদের কাজগুলোই নির্বাচন করতে হয়, যারা নন্দনতত্ত্ব নিয়ে অতটা মাথা ঘামায় নি। সেটি হতে পারে কোনও বাণিজ্যিক ‘দাগরেটাইপ’ আমলের পোট্রেট, গৃহযুদ্ধের  প্রামাণ্য ছবি, কিংবা আমেরিকার যুদ্বক্ষেত্রের ছবি। মোট কথা, সেই সব শখের কিংবা পেশাদারি আলোকচিত্রীরা কাজ করেছিলেন তাদের আপন তাগিদে, আলোকচিত্র মাধ্যমটি আদতে কোনও শিল্পমাধ্যম কিনা তা নিয়ে তারা মোটেই বিচলিত ছিলেন না। ফলে সেই যুগ থেকে আমরা এমন কাজ খুঁজে পাই যা  সমকালীন সেরা কাজের মধ্যেও টিকে থাকতে পারে।

কিন্তু ইতিহাসের এই পর্বকে আমরা আশি বছর পর যখন আবেগ কাটিয়ে ঐতিহাসিক চোখ দিয়ে বুঝতে যাই, তখন দেখি আজও পরিস্থিতি আগের মতই তালগোল পাকানো। চিত্রকলার ঐতিহ্যের সাথে এখনও যা সেঁটে আছে-বিশেষ ধরনের টেক্সচারের পর্দা, নেগেটিভের উপর হাতের কাজ; আর ধরা-বাধা কম্পোজিশনের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়।  যারা ছাকনি দিয়ে কুয়া থেকে জল তোলার পণ্ডশ্রম করে তাদের পক্ষেই ক্যামেরা দিয়ে চিত্রকলা তৈরির কারবারে নামা সম্ভব! ফটো-পেইন্টিং  প্রবণতার  পেছনে এই বদ্ধমূল ধারনা ছিল যে, সরাসরি তুলে আনা ছবি  নেহাতই একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফল আর তা স্বাভাবিক কারণেই শিল্প হতে পারে না। সেই শিল্পী তখন যান্ত্রিকতার অপবাদ ঘুচাবার জন্য বিশেষ সব কৌশল প্রয়োগ করতে শুরু করলো। এই পদ্ধতিতে নেগেটিভকে ধরা হয়েছিল নতুন কর্মপদ্ধতির সূচনা হিসেবে- যার প্রাথমিক রুক্ষ চেহারা হাত দিয়ে ঠিকঠাক করা হয় ঠিক ততক্ষন পর্যন্ত, যতক্ষণ  না এর  অ-শৈল্পিক উৎসের শেষ চিহ্নটুকু  মুছে যায়।

এটা হয়ত গায়ক গায়িকারা একজোট হয়ে যন্ত্রীদের বুঝিয়ে ফেলার মত যে, যন্ত্রীরা যে সুর সৃষ্টি করেন তা শিল্প নয়। কেননা তা সৃষ্টি হচ্ছে যন্ত্রীদের ব্যবহৃত যন্ত্র থেকে যা অবশ্যই প্রাথমিকভাবে একটি যান্ত্রিক পদ্ধতির ফলাফল। তখন যন্ত্রীরা  ফটো-পেইন্টিং এর  নজির কাজে লাগিয়ে সুরকে এমন একটি ফিতায় বন্ধী করতে পারবেন, যেন তারা ক্রমাগত তাকে পরিবর্তন করতে পারেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি সঙ্গীত-যন্ত্রের উৎকৃষ্ট সুরমূর্চ্ছনা মানব কণ্ঠের অন্ধ অনুকরণে পর্যবসিত হয়।  আলোকচিত্র মাধ্যমটির স্বরূপ বুঝতে হলে আমাদের  মূল দুইটি বিষয় বুঝতে হবে যা আলোকচিত্রকে অন্য গ্রাফিক আর্ট থেকে  পৃথক করে।

রঙের নদী: ভারতীয় চোখ

রঘুবীর সিং

অনুবাদ: আরফান আহমেদ

 

আলোকচিত্র যদি ভারতীয় আবিষ্কার হত, তাহলে আমার বিশ্বাস, পশ্চিমা আলোকচিত্রীগণ রঙে দেখাকে যেভাবে, তত্ত্বীয় ও শৈল্পিক সমস্যা হিসাবে গ্রহণ করেছেন তা কখনোই ওরকম হত না। রঙিন আলোকচিত্রকে খারিজ করার জন্য, অঁরি কার্তিয়ে ব্রেসো আড়ালে ফরাসি সেনাবাহিনীর খিস্তি ব্যাবহার করতেন, আর জনসমক্ষে বলতেন ওটা পেইন্টিং এর ক্ষেত্র। ওয়াল্কার ইভান্স রঙ্গীন আলোকচিত্রকে ঘোষণা করলেন অশ্লীল আর এন্দ্রে কার্তেজ তার বই এবং প্রদর্শনীতে কখনোই তার রঙ্গীন আলোকচিত্রগুলো ব্যাবহার করেন নি। যখন পুরো নতুন এক প্রজন্মের আলোকচিত্রীগণ রঙেকেই বেছে নিলেন, এ আলোকচিত্রীরা সাদা-কাল ছবির বিশেষ ও মূলগতঃ বৈশিষ্ট, তার দূরত্ববাচকতাকে রঙ্গিন ছবিতে এমনভাবে সংশ্লেষ করলেন, সেটি হয়ে উঠল আঙ্গিক ও আবেগের নতুন প্রকাশ।

ঔপনিবেশিকতার আগে এবং আলোকচিত্রেরও আগে, ভারতীয় শিল্পীগণ সাদাকালোতে কোনকিছুই দেখেননি, যদিও তারা রঙে পরিপূর্ণ সূক্ষ্ম ড্রইং তৈরি করেছেন। পশ্চিমে পরিচিত ড্রইং মাধ্যামটির অস্তিত্ব কখনোই ভারতে ছিল না নন্দনতাত্ত্বিক অথবা কৌশলগত ভাবে। ভারতের কখনোই কোন লিওনার্দো, রেঁম্ব্রা অথবা গয়া ছিল না। এমন কি মুঘল দরবারের অপরূপ সৌকর্যময় ড্রইং গুলো, পশ্চিমের ড্রইংগুলো থেকে একেবারে ভিন্ন। ওখানের ড্রইংগুলো সাধারনত রঙ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অথবা ‘ট্যান-ওয়াশ’ ব্যবহার করা হয়েছে যেমন ‘নীল কলম’। একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে যখন ষোল শতকে আকবরের দরবারে, উপঢৌকন হিসাবে, গোয়ার খৃস্ট্ সঙ্ঘ কাঠ-খোদাইয়ে প্যাকেট করে রয়েল পলিগলট বাইবেল প্রদান করে। চমক কেটে যাওয়ার পর, সম্রাট এবং তাঁর সভাসদগণ এবং শিল্পীগণ নিশ্চিত ভাবেই কল্পনায় কাঠখোদাইয়ের খালি যায়গাগুলো রঙে পরিপূর্ণ করে ছিলেন। জাহাঙ্গীরের জন্য তৈরি করা, সতের শতকের বিখ্যাত শিল্পকর্ম, ইনায়েৎ খাঁ-র মৃত্যুতে ছিল না অন্ধকার আমেজ অথবা ইউরোপীয় মহৎ শিল্পকর্মের মত আলো-ছায়ার কারসাজি। ড্রইং ছিল পেইন্টিঙের প্রস্তুতি। এ ধরণের ড্রইংগুলো,রাজকীয় সংগ্রহশালার বদলে পাওয়া যায় শিল্পীদেরই নিজস্ব সংগ্রহশালায়। আজ এ ধরনের ড্রইং অপ্রতুল, যে ধরনের ড্রইংগুলি উজ্জ্বল মুঘল আর রাজপুত পেইন্টিং এ, তাদের গৌণ ভুমিকার ইঙ্গিত দেয়।

প্রাচীন কাল থেকেই ইহুদী-নাসারা দুনিয়া, রঙ দেখেছে তাত্ত্বিক অগ্রগতির চোখ দিয়ে। চাগাল-এর সময় পূর্ব পর্যন্ত ইহুদী সভ্যতার রঙ এবং রেপ্রেজেন্টেশন সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না; সে সময়ে খৃস্ট সভ্যতাও রঙের প্রতি দেখিয়েছে বৈরীতা। ক্যেনেথ ক্লার্ক তার সিভিলাইজেশন বই এ আলাপ করেছেন, টার্নার এবং প্রকৃতির সাথে শিল্পের মনস্তাত্বিক সম্পর্ক বিষয়ে। তিনি এই বলে উপসংহার টানেন যে, ধারণা করা হত রঙ হল পাপাত্মক। হয়তোবা সত্যি, কারণ এটি হল তাৎক্ষণিক ভাবে উত্তেজনাকর এবং এটি নৈতিকতার ভিত্তি ক্রমিক স্মৃতি সমূহকে স্বাধীন ভাবে প্রভাবিত করে’। কলার এন্ড কালচার গ্রন্থে জন গেজ, রঙের নৈতিকতা সম্পর্কে পুরো একটি অধ্যায়ই লিখে ফেলেন, যা এরিস্টটোল থেকে শুরু হয়ে ক্যান্ডিন্সকি-তে এসে শেষ হয়। চার্লস এ. রিলে, কালার কোডস-এ বলেন, রঙ হল দুশ্চিন্তার উৎস…

উইলিয়াম ইগ্লস্টন গাইড পরিচিতি

জন সারকৌস্কি

অনুবাদ: সিউতি সবুর

 

জগতে যত না ইট ব্যবহৃত হয়েছে তার চেয়ে ফটোগ্রাফের সমাহার বেশী,এবং সবকটি ফটোগ্রাফই আশ্চর্যজনক ভাবে আলাদা। এমনকি সর্বোচ্চ নিষ্ঠাবান ফটোগ্রাফারের পক্ষেও শ্রেষ্ঠ ফটোগ্রাফারের প্রথমদিককার কাজ হুবহু নকল করা সম্ভব হয় নি।

এটা প্রমানের জন্য পাঠক চেয়ারে বসে কোন নড়াচড়া ছাড়া একটা ফ্যামেলি ইন্সটাম্যাটিক বা লেইকা ক্যামেরাতে পুরো রোল ছবি তুলতে পারেন : এলোমেলোভাবে এদিকে ওদিকে ক্যামেরা তাক করুন,দ্রুত এবং কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই। যখন ফিল্ম ডেভেলপ করা হবে, দেখা যাবে প্রতিটা ফ্রেমে ছবি আগেরটা থেকে ভিন্ন হবে। পরিস্থিতি আরো বাজে হবে যখন আপনি ঠাহর করবেন কিছু ছবি খানিকটা হলেও কৌতূহলোদ্দীপক। এমনকি অটোম্যাটিক ক্যামেরা যা ব্যাঙ্কে লোকজনের গতিবিধি রেকর্ড করে তাতেও ওখানকার ঘটনাঘটনের সম্পর্কটা এমন ভাবে ধরা পড়ে যা সাধারণ কোনো প্রতক্ষদর্শীকে অবাক করে।

ফটোগ্রাফারের পক্ষে চেতনাহীন ক্যামেরা যন্ত্রের দক্ষতা বা মৌলিকতার সঙ্গে পাল্লা দেয়া সহজ নয়,কিন্তু ফটোগ্রাফার তাঁর মেধা কাজে লাগাতে পারেন। ফটোগ্রাফিতে কেউ এক মিনিটে নিরানব্বই রকম অসন্তোষজনক ঘটনা-বিন্যাস বাতিল করে শততমটা বেছে নিতে পারেন। বাছাইটা হয় অন্যান্য শিল্পের মতোই  প্রথা এবং সহজাত উপলব্ধি নির্ভর, জ্ঞান আর অহং এর সমন্বয়ে। কিন্তু ছবি তোলার যে সহজসাধ্য কাজ এবং ফটোগ্রাফিতে সম্ভাবনার যে প্রাচুর্য্য, তা প্রখর সহজাত তাড়নার অধিকারীর জন্য একটা বাড়তি পাওনা। ফটোগ্রাফারের সমস্যা হয়তো অনেক বেশি জটিল যা যুক্তি দিয়ে সামলানো সম্ভব নয়। একারণেই ফটোগ্রাফাররা মটিফ নিয়ে অনিশ্চয়তা সমেত অস্থিরভাবে ঘুরঘুর করতে থাকে। অন্য কিছুর খোঁজে ব্যস্ত থাকে বলেই সামনে আগ্রহ জাগানোর মতো শক্তিশালী সব রেকর্ড উপেক্ষা করে যায়।

আমেরিকান ফটোগ্রাফার রবার্ট এ্যডামস এই ঘুরঘুর করা তরিকা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন: ‘বারবার ফটোগ্রাফার কয়েক পা হাঁটেন এবং বেশ কৌতুককর ভাবেই ক্যামেরাতে চোখ রাখেন,পরিবার এবং বন্ধুদের বিরক্তি সমেত তিনি অগনিত এ্যঙ্গেলের ছবি জড়ো করতে থাকেন। যদি প্রশ্ন করা হয় তবে ব্যাখ্যা করেন যে তিনি যুতসই একটা কম্পোজিশন বের করতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেটার সংজ্ঞা দিতে বললে দ্বিধায় পড়ে যান। তিনি যা বলতে চান তা হল ফটোগ্রাফার ফর্ম চান…