ফিরিস্তি

মুনেম ওয়াসিফ ও তানজিম ওয়াহাব

…ওয়াসিফ: জিনিসটা যথেষ্ট ভাঙ্গছে। আসলে বাংলাদেশের এই ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট সোশ্যাল ডকুমেন্টরি নিয়া আমরা যতটুক ভীত, এত ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আপনি যদি একটু গোনেন আমার কাছে মনে হয় না এদেশে সোশ্যাল ডকুমেন্টরির সাত আটটা ক্লাসিক কাজ বের হবে।

তানজিম: ক্লাসিক বলতে আপনি কি বুঝাইতেছেন?

ওয়াসিফ: ক্লাসিক বলতে, মানে কালজয়ী। ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা কিংবা সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালির মত, যুগে যুগে মানুষ যেটা মাইল স্টোন হিসাবে দেখবে।

তানজিম: আপনাকে আমি জিগাইলাম কারণ আপনার কথায় অনেকে আবার ক্লাসিক বলতে ডকুমেন্টরিতে ক্লাসিক এপ্রোচ না ভাবে। একটা অভিযোগ হইল এ জায়গায় ডকুমেন্টরিতে বেশি দেখা যায় ক্লাসিক এপ্রোচ, মানে গল্প বলার পুরানা পদ্ধতি এবং আধুনিক যুগে অনেকে ভাবে এইটা আমগো পিছায়া দিতাছে।

ওয়াসিফ: সেই একটা জায়গায় সাত আটটা স্ট্রং কাজ হইছে, হুইচ ইজ ফেয়ার এনাফ। এবং আমার কাছে মনে হয় পরের জেনারেশন এইটার মধ্যে অনেক ইন্টারেস্টিং টুইস্ট দিছে এবং অনেক জায়গা তৈরি হইছে। ধরেন সেইখানে রাসেলের মত ফটোগ্রাফার একটা আরবান ল্যান্ডস্কেপ করতেছে, কালারে একদম মেলানকোলিক একটা স্যাড কালার টোন, সেখানে ধরেন তুশিকের মত ফটোগ্রাফার তার নিজের জীবনের সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি নিয়া ছবি তুলছে।

তানজিম: কিংবা সুমনের মত ফটোগ্রাফার তার সেলফ পোর্টেট এবং নিজের মায়ের সাথে স¤পর্ক নিয়ে কাজ করছে, ব্যক্তিগত ইমোশন দিয়া…

ওয়াসিফ: হু… তার সাথে সাথে কিন্তু আমার ধারণা এই ভিন্নভাবে গল্প বলার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই ছিল। ধরেন মুন্নি আপা বহু আগে তার ফ্যামিলি নিয়ে একটা স্টোরি করছে কিংবা সামিরা বহু দিন আগে ছবি এবং টেক্সট ওভারলেপ করে ইন্টারেস্টিং কাজ করছে। কিন্তু যেটা হইছে, ভিন্ন কাজগুলা করার যে প্রবণতা ছিল, সেটা কোন কারণে উৎরাইয়া যায় নাই, স্টাবলিস্ট হয় নাই, কোন কারণে ইন্টারন্যাশনালি লিংকড হয় নাই। কিংবা আমরা এই কাজগুলাকে পাটাতন দিতে পারি নাই। ফলে সেই কাজগুলা হারাইয়া গেছে। আবার এখন যে নতুন কাজ হইতেছে, যেটা আমাদের কাছে দেখে র‌্যাডিক্যাল মনে হইতেছে, মনে হচ্ছে যে ক্লাসিক্যাল ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফিতে এইটা টুইস্ট মারছে। ফটোগ্রাফাররা অনেক বেশি পার্সোনাল, ইন্টিমেট, কমপ্লি­কেটেট স্টোরি বলতেছে, এইটা কিন্তু একটা সময় ক্লিসে হয়ে যেতে পারে। যেইটা এখন ইনডিয়ায় হইছে। সব ফটোগ্রাফারই একটা মিডিয়াম ফর্মেটে, সেøা, বোরিং, একধরনের মিডিল ক্লাসের গল্প বলে। এবং সেই ছবিগুলা গ্যালারিতে যায় এবং গ্যালারিতে গেলে সেটা একটা এডিশনে বিক্রি হয়। এবং সেটা হিস্ট্রিক্যালি ফটোগ্রাফির নানান রকম কনটেক্সটের সাথে জড়িত বলে একটা থিউরিটিক্যাল প্যাঁচাল হয়। সো আমার কাছে মনে হয় প্রত্যেকটা সময়ই একটা নতুন গল্প বলার ধরন আসে, কিন্তু সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল, যে গল্পটা আপনি বলেছেন সেই গল্পটার সাথে আপনি কানেক্টেড কি না। কিংবা আপনি ফিল করেন কি না।

তানজিম: সেই জায়গাটায় আমি বলি ‘ভিন্ন’ এবং ‘নতুন’ এই দুইটা শব্দই একধরনের ট্র্যাপ। আমরা ‘ভিন্ন’ বলতে আসলে কি বুঝাই? ‘ভিন্ন’ কি শুধুই আসলে ভিন্ন কিছু করার জন্যই? শুরুতে আমাদের কিন্তু সেরকম আর্গুমেন্ট ছিল না, আর্গুমেন্টটা ছিল একজন নতুন ফটোগ্রাফার আসলে কতগুলা জানলা খোলা পায় এবং সে কত বৃহৎ ভাবে ডকুমেন্টরিটা বুঝতে পারে। তারপর যেই জায়গাটা তাকে টানে, যে জায়গাটায় সে কানেক্টেড ফিল করে, নিজের সাথে সম্পর্ক খুঁজে পায়, যেটা সে বিশ্বাস করে, কিংবা যেটা তাকে অনেক এক্সাইটেড করে, ইন্সপাইয়ার করে, সে ঐ কাজটা নিবে। তার জন্য ইন্ডাস্ট্রিতে সেই সুযোগ আছে কি না?

ওয়াসিফ: আমার কাছে একটা জিনিস মনে হয়, আমরা আসলে অনেক বেশি ফটোগ্রাফির ভিতরে আছি। এবং অনেক ধরনের ফটোগ্রাফিক স্কুল, দেখা, রাজনীতি এইগুলা নিয়া আমরা আসলে এত জর্জরিত! মাঝে মাঝে আমরা ফটোগ্রাফির যে একটা খুব সাধারণ, ইনোসেন্ট বিউটি আছে সেটার কথাও ভুলে যাই। কিন্তু ওইটাই আমার কাছে মনে হয় ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফির সবচেয়ে বড় স্ট্রেঙথ। ধরেন, মানে বাংলাদেশেই ধরেন, আমার খুব মজার লাগে ফ্যামিলি এ্যালবামে যে ছবিগুলা দেখা যায়, কিংবা ধরেন আমরা এইবার যে ছবিগুলা ছাপাচ্ছি, মানে হিন্দুরা মরা মানুষের যে ডকুমেন্ট করে, কিংবা ধরেন পুলিশ কিংবা মেডিকেলে কেস স্টাডির মত করে যে ছবিগুলা তোলা হয়, কিংবা যুদ্ধে আর্মির একজন ফটোগ্রাফার একদম ফটোগ্রাফিক এপ্রোচ বাদ দিয়ে একদম নিখাদ ডকুমেন্ট করার জন্য যে ডকুমেন্টগুলা করে… আমার কাছে মনে হয় ফটোগ্রাফির একটা ইন্টারেস্টিং জায়গা হইল ফটোগ্রাফাররা ছাড়াও এই ফটোগ্রাফি এবং ফটোগ্রাফ, দুইটা জিনিসকে নানান মানুষ নানানভাবে ব্যবহার করে। এবং এটা যদি আপনি ভাল করে দেখেন, এটার ভিতরে অনেক ভাঁজ আছে। এটার ভিতর অনেক তরিকা আছে এবং অনেক ইনোসেন্স, নাইভ, ইন্টারেস্টিং দেখার জায়গা আছে। আমাদের মাঝে মধ্যে এই জ্ঞানের গরিমা থেকে বের হয়ে একটু সহজ মনে ছবিগুলো দেখা দরকার। তাইলে হয়ত অনেকগুলা ছবি আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে। ইন দ্যা এন্ড অফ দ্যা ডে, আপনি আসলে কোন স্কুলে কেমনে কি ডকুমেন্ট্রি ফটোগ্রাফি করবেন এইটা ইম্পরট্যান্ট না, কাজটা যদি আসলেই ভাল হয় এবং ওটার ভিতর যদি প্রাণ থাকে, ওটা যুগের পর যুগ ধরে টিকে থাকবে।

তানজিম: হ্যাঁ। কিন্তু আরেকটা জিনিস হইল, যে ছবিটায় প্রাণ দিল, দরদ দিয়া তুলল, এই ছবিটা আমরা আসলে তুলি কার জন্য? আমরা কখনও তেমন একটা বলি না যে কারে দেখানোর জন্য ছবি তুলি। অলরেডি ইন্ডাস্ট্রির কথা বলছি, গ্যালারির কথা বলছি, পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলছি, বলছি আমি কি দেখাইতে চাই, আমি কি করে কানেক্টেট, কিন্তু এই ছবিগুলোর দর্শক কে? তারা আসলে কোন ছবিগুলা খুঁজে? কই ছবিগুলা পায়? যেমন আপনি বললেন যে অদ্ভূত কিছু ছবি আছে যেইটা ফ্যামিলির ছবি, বাংলাদেশে কিন্তু এই রকম ছবি নিয়া ইন্টারেস্টিং কিউরেশন এখনও হয় নাই। কেবল শুরু হচ্ছে ছবিগুলাকে ভাল করে দেখা, সংরক্ষণ করা, ছবিগুলাকে দেখানো। আমরা বাংলাদেশে যে ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফি করি, এইটা স্পেসিফিক্যালি এজেন্সি ওরিয়েন্টেড বা বিদেশি গ্যালারি ওরিয়েন্টেড, সাধারণ মানুষের আসলে ছবি দেখা খুব বেশি হয়ে ওঠে না বাংলাদেশে।

ওয়াসিফ: সেটা একদিক থেকে সত্যি এবং এই কথাটার অনেকগুলা ভাঁজ আছে। আমার কাছে মনে হয় ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে এইটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। যেমন ধরেন সালগাদো যে ধরনের কাজ করে। আমরা খালি সালগাদোর সেই ছবিগুলাই দেখি যেগুলা জায়ান্ট, এপিক, ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট হিউজ স্টোরি। কিন্তু এর সাথে সাথে সালগাদোর একটা খুব ইন্টারেস্টিং এক্সিবিশন ছিল, ল্যাতিন আমেরিকার ট্রেনের ভিতরে ছবি পেস্ট করছে এবং সেই ট্রেনটা ল্যাতিন আমেরিকার বিভিন্ন শহরের মাঝখান দিয়ে গেছে এবং স্টেশনে যখন ট্রেনটা দাঁড়াইত, যাত্রীরা ঢুকত আর বের হইত এবং তারা ছবিগুলো দেখত, খুব ইন্টারেস্টিং কিন্তু। কিংবা ধরেন সুসান মাইসেলাস যখন তার তোলা নিকারাগুয়ার যুদ্ধের ছবি যুদ্ধের ২৫-৩০ বছর পর গিয়ে এক্সাক্টলি সেম লোকেশনে, যেখানে ছবিটা তুলছে, সেখানে ছবিগুলা এক্সিবিট করে এবং পাবলিকের সাথে যে ইন্টারেকশন হয় সেটাও খুব প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। কিন্তু অন্য জায়গা থেকে আমার আরেকটা জিনিসও মনে হয় যে, সব ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফার যে ছবি দেখায় তা কিন্তু না। যেমন ধরেন কুদেলকা সারা জীবন অনেক কাজ করছে। কিন্তু খুব অল্প ছবি আমরা দেখতে পাইছি। যেমন ধরেন লাস্ট ১০ বছরে কুদেলকা কোন ছবি কাউকে দেখায় না। কিংবা ধরেন একজন স্ট্রিট ফটোগ্রাফার। কয়েকদিন আগে বলা হইছে রবার্ট কাপা আর তার বউ এর মেক্সিকার একটা সুটকেস আবিষ্কার হইছে, সেইখানে তাদের মেক্সিকো ট্রিপের হাজার হাজার নেগেটিভ ছবি। তো আমার কাছে মনে হয়, এখনকার ফটোগ্রাফির চল অন্যরকম। ডিজিটাল ক্যামেরা আসছে, আপনি একটা এজেন্সির সাথে রিলেটেড, সো ছবি তোলেন আর সাথে সাথে ডাউনলোড করেন। কি ওয়ার্ডটা ফিল ইন করেন, প্লাগ কানেক্টেড করেন, ছবি নিউইয়র্ক টাইমস-এ চলে যায়। নিউইয়র্ক টাইমস এর ব্লগে আপনার ছবি দেখা যায়, সেই ছবি আপনি আবার ফেইসবুকে পোস্ট করেন। সেখানে একশটা লাইক পরে এন্ড ইউ আর ইন এ কম্পিটিটিভ, সুপার স্পিড ফ্রেম ওয়ার্ক। সবসময় কিন্তু জীবনটা এই রকম হওয়ার কথা না, কিংবা সবসময় তাড়াহুড়া করে ছবি তোলারও দরকার নাই। আপনার কিন্তু দম নেবার সময় আছে এবং স্থির হবার সময় আছে। ধরেন ফটোগ্রাফিতো অনেক সময় জীবনানন্দ দাশের কবিতার মত করেও হতে পারে। আপনি আপনার নিজের খাতায় লিখবেন এবং সেটা রাখবেন। দীর্ঘ দিনে ছবিটার সাথে কিংবা কবিতার সাথে সাথে বড় হবেন এবং একটা পর্যায়ে গিয়ে হয়ত প্রকাশ করবেন।