আলাপচারিতা- নাসির আলী মামুন
মুনেম ওয়াসিফ
মুনেম ওয়াসিফ: আচ্ছা তাইলে আপনি প্রথম দিকে, একদম মনে আছে এই যে ধারণাটা আপনার হইল, যে মানুষের চেহারার ছবি তুললে এইটারে পোর্ট্রেট বলে, উপর থেইকা তুললে এইটাকে এরিয়েল ফটোগ্রাফি বলে। প্রথম দিকে আপনি কার পোর্ট্রেট তুলছেন? মানে আপনার বন্ধু-বান্ধব…
নাসির আলী মামুন: আমিতো প্রথম ৬৮/৬৯/৭০ সালের দিকে বন্ধু-বান্ধব, আর ভাই-বোনদের ছবি তুলছি ঘরের মইধ্যে। সেইগুলি অল-মোস্ট স্টুডিওর পাসপোর্ট ছবি মতই আরকি। তাও সেই ছবির মধ্যে আমি খুব চেষ্টা করতাম প্লেইন একটা ওয়ালের সামনে, যেগুলিতে দাগ-টাগ আছে… কিংবা বড় মোটা কোন গাছ, ওরা সবাই ছবি তুলতে চাইত পার্কে গিয়া, রমনা পার্কে যাইতে চাইত, ধানমন্ডি লেকে, যেইটা আমার বাসার থাইকা কাছাকাছি ছিল। এই রকম গেছিও ওদের পীড়াপীড়ির কারণে, ঐখানে গিয়া আমি বড় বড় গাছ খুঁজতাম। বড় বড় গাছের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছবি তুললে, গুড়িটা প্লেন একটা ওয়ালের মত দেখা যাইত, পিছের আমি গাছ-পালা কিছু আনতাম না। তাতে ওরা বিরক্ত হইত। ওরা পছন্দ করত ফুলের সামনে… পরে যখন বি টু সাইজের ছবি প্রিন্ট করতাম, খুব পপুলার একটা সাইজ ছিল তখন, এইটা দীর্ঘদিন, এইটিস পর্যন্ত— ছিল বি টু সাইজ। বি টু সাইজ টা এখনকার যে থ্রি আর সাইজটা আছে, ওটা থেইকা একটু ছোট আরকি। তো ওরা দেখলে বিরক্ত হইত কিন্তু আমার দেখতে খুব ভাল লাগত যে প্লেইন, অন্য ট্র্যাডিশনাল ছবির বাইরে। যে ফুল নাই, নদী নাই, লেক নাই, গাছ-পালা নাই, একটা প্লেন ব্যাকগ্রাউন্ড। তো এই রকম আমি মাথার মধ্যে তখনই আসল যে, মানুষের ছবি একটু আলো-আঁধারই রাখলে কিরকম হয়। তখন লেখকদের বই উলটাইতাম আমি, ফ্লপে যে লেখকের ছবি আমি দেখলাম, আমি তারে তো আমি দেখছি গত সপ্তায়, ওমর অনুষ্ঠানে, সে তো এই রকম না। তাঁর গর্ত আছে, সে কালো, কিন্তু মুখ ফোলা তাঁর, ফর্সা, তাঁর বসন্তে—র দাগ ছিল—দাগ নাই। এইটা কেমন? আমি তখন চিন্তা করলাম, না, এই রকম ছবি তো ছবি না। তখন আস্তে আস্তে আমারও চোখ আমি ঘুরাইলাম, যে মানুষের মুখের মধ্যে যা আছে, ক্ষত বিক্ষত এইগুলা সব আনতে হবে, শুধু তাই না, তার যে হৃদয়ের বেদনা, তার যে আনন্দ, তার যে উচ্ছ্বাস সব ছবির মইধ্যে আনতে হবে। তার কষ্ট ছবির মধ্যে থাকতে হবে, থাকা উচিৎ আমি মনে করি, ঐটাই পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি। এবং তখন আমার মনে হইত যে, ও বলত যে স্টুডিও ফটোগ্রাফি একটা সাইনবোর্ড আমি তখন দেখলাম যে, না আমি ত সাইনবোর্ড পেইন্টার হইতে চাই না। সাইনবোর্ড আঁকাইয়া হইতে চাই না।
মুনেম ওয়াসিফ: যেই সময়ের আপনি এই ফটোগ্রাফির প্রতি আপনার আগ্রহ ছিল, তখন কি আপনার কোন কবি, সাহিত্যিক কোন বন্ধু-বান্ধব ছিল? আপনি সিদ্ধান্ত—টা কখন নিলেন, যে আপনি এই বিখ্যাত লোকজন এর পিছন ছুটবেন বা এদের ছবি তুলবেন? কারণ ঐ সময়ে আপনি একদম পেসিফিকলি একটা অন্য জায়গায় ছবি তোলা শুরু করলেন এবং আমি যতদূর জানি সেই অর্থে বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, বি পি এস, ঐ গুলার সাথেও আপনি সম্পৃক্ত ছিলেন না। আপনি একদম আলাদা, নিজের মত করে কাজ করে গেছেন…
নাসির আলী মামুন: আমি নিজের মত, নিজের স্বতন্ত্র রাস্তা নির্মাণ করার চেষ্টা করছি। ফটোগ্রাফি লেভেলের কেউ ওই ভাবে, মানুষ বলে না যে আপনার গুরু কে? ঐ রকম আমার কেউ নাই। বরঞ্চ এই পর্যন্ত পদে পদে হোঁচট খাইতে খাইতে… শিয়াল, কুমির, সাপের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইতে হইতে এই চল্লিশ বছর বেয়াল্লিশ বছর হইছে ফটোগ্রাফি কইরা আমি আসছি। সত্য কথা বলি—সফল ফটোগ্রাফার হইছি? না আমি হইতে পারি নাই। তোমাদের ছবি দেখলে আমি বুঝি যে, আমি কত ছোট আমি কত পিছে। আমি কোন জায়গায় আছি? আমি পাঠক তো, তারপরেও আমার কৃতিত্বটা কি? এইটা হইল যে, পুরা জাতিরে, প্রিন্ট মিডিয়ারে এবং প্রকাশনা জগতের চোখ এবং তাদের টেস্ট আমি ঘুরাইছি। ঐ চল্লিশ পাঁচ্চল্লিশ বছর আগের লেখকের ছবি বা আর্টিস্টের ছবি, ছবি না। আমি যে ছবি দিতেছি এইটা হইল তার আসল চেহারা। এইটা তার আত্মা, এইটা তার চেহারা, এইটা তার সিগনেচার, এইটা তার ঠিকানা। অন্তত মিডিয়ার লোকেরা এখন বোঝে, আর প্রকাশনা জগতের এরাও বোঝে। তো এদের এই চোখটা আমি ঘুরাইছি। এইটা নিয়া হয়ত বিশ বছর পর কেউ কাজ করলে করবে, যে আমি এই কাজটা প্রথম করছি বাংলাদেশে। আমি ভাল পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি করি নাই। ঐ প্রথম ফটোগ্রাফি থাইকা এই ফটোগ্রাফিতে আসছে, আনছি। মেকি ফটোগ্রাফি, যেটা স্টুডিও ফটোগ্রাফি—যেইটার মধ্যে কোন শিল্প নাই। শিল্পটা কি? তুমি কইতে পার যে শিল্পটা কি? শিল্পটা হইল যে-পরিষ্কার, স্বচ্ছ পানির মধ্যে তুমি একটা লাঠি ঢুকাইছ, সেই লাঠিটা স্বাভাবিক ভাবে মনে হবে যে সোজা, কিন্তু সোজা নাই। পানির মধ্যে যখন দেখবা লাঠিটা বাঁকা হইয়া গেছে ঐটাই শিল্প। সেইটা করার চেষ্টা করছি কিন্তু আমার পোর্ট্রেট সেই রকম হয় নাই, আমার পোর্ট্রেট পানির মধ্যে দেখা যায় সোজাই আসলে। কিন্তু আমি রাস্তাতো বানাইছি। তোমরা এই রাস্তার মধ্যে পিচ দিয়া রাস্তা ঢালাই করবা, এই রাস্তায় তোমরা এখন গাড়ি চালাইতেছ।
মুনেম ওয়াসিফ: কিন্তু বিখ্যাত মানুষের ছবি তুলতে গেলেন কেন? সদর ঘাটের একটা নৌকার মাঝি, বৃদ্ধ একটা চেহারা তার মুখেও ঐ কষ্ট আছে. আপনি তার ছবি না তুলে শামসুর রাহমানের ছবি তুলতে গেলেন কেন?
নাসির আলী মামুন: তার মুখেও কষ্ট আছে, কিন্তু তার আবার মেধা নাই। আমি হইলাম চিরকাল মেধাবী মানুষদের পূজারী এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল মানুষ। কবি, সাহিত্যিক, লেখক, অর্থনীতিবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিবিদ, সংগীত শিল্পী, পেইন্টার, আমি সব সময় এদের আচরণে, এদের কথা বার্তায়, জীবন যাপনে এবং এদের কাজ-কর্মেতে অভিভূত হইতাম। সবসময় ফ্যাসিনেটেড, এখনও হই। বিস্ময় ভাবে হই। যেমন যেকোনো মানুষ, বিখ্যাত মানুষকে দেখলেই আমি তাকে প্রথমে এমন একটা পর্যায়ে নিয়া যাই, মানুষের সাথে আলোচনা করতে গেলে, যে সে ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রেটি। না হইলেও আমি কথায় প্রমাণ করার চেষ্টা করি যে, সে ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রেটি। কাজেই আমি এমন একটা ক্যারিসমেটিক জগত নিজের মধ্যে তৈরি করছিলাম যে, ঐটা আমার ব্লাডের মধ্যেই মিশা গেছিল, বিখ্যাত লোক ছাড়া আর কিছু বুঝি না আমি। আর আমার পরিবারের মধ্যে একজন ছিল খুব নামকরা কবি, ছোট বেলা থেইকা তাকেও আমি দেখতাম। তাঁর জীবন-যাপন এই রকম পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে, খালি গাঁয়ে থাকে, লুঙ্গি পইড়া ঘুরতাছে। জসীম উদদ্দিন এর কথা কইতেছি। দেখলাম যে তাঁর সৃষ্টি কর্ম এই রকম, সারা বাংলাদেশের লোক পড়ে, বাংলা সাহিত্যের সবাই পড়ে। পিএইচডি করতাছে, ইউরোপ-আমেরিকায় তাঁর বই নিয়া কাজ হইতাছে, অনুবাদ হইতাছে। আমিতো এদের উপরেই কাজ করব। ছোট বেলায় মনে হইত আর কি। পরে যখন বাহাত্তর সালে আমি ক্যামেরা হাতে নিলাম প্রথম, আমার নিজস্ব^ কোন ক্যামেরা ছিল না। ধার করা ক্যামেরা, তখন আমি কাজে লাগাইলাম-এইসব মানুষদের যে ইমেজ আমার মধ্যে রইছে, সৃষ্টিশীল মানুষ এদের উপর কাজ করব, পোর্ট্রেট করব। এদের দুঃখ, বেদনা এগুলোর উপর কাজ করব।
মুনেম ওয়াসিফ: ধরেন রিচার্ড অ্যাভেডন, হেনরি কিসিজ্ঞারেরও ছবি তুলছে আবার মেরলিন মনরোর ছবি তুলছে। কিন্তু আপনার ছবি দেখলে আমি যেমন দেখি, আপনি খালি অ্যালেন গিনসবার্গ-এর মত মানুষের ছবি তুলছেন। আপনার ছবিতে বিখ্যাত মানুষদের ভিতরে আপনার একটা সিলেকশন আছে। আইদার তারা খুব রুচিবান, অথবা সত্যিকার অর্থেই তারা খুব ইন্টেলেকচুয়াল অথবা তারা আপনার অর্থে ভাল মানুষ। ধরেন খারাপ মানুষও তো বিখ্যাত হয়, আপনে তো সুইডেন আসলামের ছবি তোলেন নাই। তার মানে আপনার এই ভাল মানুষের মধ্যে একটা সিলেকশন আছে। এইটা কি আপনে মনে করেন আপনার ব্যক্তিগত রুচির জায়গা থেইকা তৈরি হইছে?
নাসির আলী মামুন: আচ্ছা, সত্যি বলি, প্রথমত আমার কাছে যারা গুরুত্বপূর্ণ তাদের পোর্ট্রেটই আমি করি। এখন তোমার মনে হইতে পারে… যে বিখ্যাতর কোন সংজ্ঞা নাই। আজকে যে বিখ্যাত, দশ বছর পরে সে দেখা গেল একদম বিখ্যাতই না। আবার আজকে যে বিখ্যাত না তারে হয়ত আমি রিকোগনাইজ করতে পারলাম না। যে রকম আরজ আলী মাতুব্বররে আমরা চিনি নাই। কত ঘুরত বাংলা একাডেমীতে, ন্যাশনাল বুক সেন্টারে ঘুরত, কেউ পাত্তা দিত না। পান খাইত, চা খাইত আর গল্প করত, কেউ চিনে নাই, আমিও তো চিনি নাই, আমিও দেখছি, আমিও তার ছবি তুলি নাই।
মুনেম ওয়াসিফ: সেই অর্থে বলি নাই মামুন ভাই। আমি বললাম যে, আপনার মানুষ চেনার ধরনটা বুঝতে চাই কারণ আমি দেখছি যে আপনি অনেক এরকম লোকের ছবি তুলছেন যারা এখনও বিখ্যাত হয় নাই, কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন, যে এই লোক মেধাবী এবং এই লোক হয়ত কিছু একটা হবে। এবং আপনি অনেক আগেই তার ছবি তুলছেন।
নাসির আলী মামুন: না, এইটা বোঝা যায়, যেমন আমার মনের মধ্যে একটা রাডার আছে ঐটা বুঝতে পারে যে, টোকা দিলে যেরকম কলসি বাজে না? এইটা বোঝা যায় যে, কার মধ্যে মেধা আছে। এই রকম আমি ভুল করছি শতকরা দুই জন। বহু মানুষের যেমন-রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, এই লেভেলের ছবি তুলছি ওরা যখন কবি হয় নাই, বই প্রকাশ পায় নাই, সেভেন্টিজে এদের ছবি তুলছি। পরে আমি দেখছি যে, ম্যাক্সিমাম এদের বেশির ভাগই কিন্তু উৎরাইয়া গেছে। তারা সৃষ্টিশীল হইছে, দেশে নাম করছে, ভাল কাজও করছে। ৫০টা ১০০টা বইও অনেকের আছে, আমি তাদের ছবি তুলি নাই, এমন বহুলোক আছে। আমারে ফোন করে, ঘুরে ছবি তোলার জন্য এমন বহু লোক আছে। তুলি না ছবি।