মার্থা রসলার
অনুবাদ
এস এম মনিরুজ্জামান ও সম্পাদনা পর্ষদ
আমরা যদি আজও ডকুমেন্টারির মত একটা নিত্য পরিবর্তনশীল ধারণার অর্থ ভালভাবে বুঝতে চাই, দুর্ভাগ্যের বিষয় তাতে পিছনে ফিরার প্রয়োজন পড়ে খুব সামান্যই। সময়ান্তরে ডকুমেন্টরি কথাটার অর্থ নানান রূপ এবং ভঙ্গি অদল বদলের মধ্যে দিয়ে গেছে। ফলত, পরস্পর বিরোধী সংজ্ঞাও পয়দা হয়েছে। ডকুমেন্টরি ধারণাটির অসঙ্গতি এর নিজস্ব ইতিহাসের কোন শেকড়ে জড়িয়ে আছেÑ অতীতে পুনর্দৃষ্টি কেবল তার হদিসটুকু উন্মোচিত করবে। ডকুমেন্টরি অভিধাটি আদতে কি অর্থ ব্যক্ত করে সে বিষয়ে আজও কেউ নিশ্চয় জ্ঞান হাসেল করতে পারে নাই ফিল্মের কথা টানলে, আপাত একটা সংজ্ঞা পয়দা করা সম্ভবÑ মোটা দাগে যা কিছু ফিকশন নয় তাই ডকুমেন্টরি। কিন্তু ফটোগ্রাফিতে ডকুমেন্টরির বিপরীতে এমনতর কিছু দেখানো কঠিন, কেননা ফটোগ্রাফির মধ্যে কোন জিনিসকে আমরা ফিকশন বলে আলাদা করে দেখাব? কাজেই ডকুমেন্টরি অভিধাটির প্রকৃত পরিসর নির্ধারণের মুশকিলটাও এখানেই নিহিত। সে যাইহোক, অর্থবোধকটার এই অস্পষ্টতা চলার পথে বিশেষ বাধা হয়ে দাঁড়ায় নাই; বরং এর সাফল্য এবং ছড়িয়ে পড়ায় সহায়ক বনেছে, জগত জুড়ে নানান কিসিমের নির্মাতারা নিজের কাজটাকে এই তকমায় মুড়িয়ে চালিয়ে দিয়েছে, মানুষের কাছে ফেরি করেছে। গত প্রায় এক শতক জুড়ে ডকুমেন্টরির প্রভাব-প্রতিপত্তির বড় কারণ রয়েছে অভিধাটি দেদারসে ব্যবহারের এই অবাধ স্বাধীনতায়।
…একটি ছবিতে দেখা যায় ফ্রান্সের গ্রামের ছায়াঘন বীথিকা (দু’ ধারে গাছের সারি অলা রাস্তা) দিয়ে এক লোক আর এক পিচ্চি কালো গোল ক্যাপ পরে একটি বাইসাইকেলে চড়ে যাচ্ছে— সাইকেলের পেছনে ঝুলছে একটি রুটির ব্যাগ। এই ছবিটাই আমি বছর-খানেক আগে দেখছি। ডয়েল ডেইন বার্নবাখ বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্য এলিয়ট এরউইট পঞ্চাশের দশকে ছবিটা তুলছিলেন। এলিয়ট ছবিটির জন্য ১৫০০ ডলার পেয়েছেন। ছবিটি লাগেনি’। তাহলে আলোকচিত্রও কি সভ্যতার মতই, শোষণের উপর ভিত গেড়ে দণ্ডায়মান? আমি জবাবে বলেছিলাম, ‘ইন দিস প্রাউড ল্যান্ড’ নামক বইয়ে ল্যাঙের টুকে রাখা নোট থেকে উদ্ধৃতি উল্লেখ করছে যে, ‘তিনি (থমসন) ভেবেছিলেন যে, আমার তোলা ছবি তাকে সাহায্য করতে পারে এবং এই ভেবে তিনি আমাকে ছবি তুলতে দিয়েছিলেন’। আমার বন্ধু লেবার ফটোগ্রাফার পাল্টা জবাবে বলেন: ‘আলোকচিত্রটির প্রকাশনার ফলশ্রুতিতে স্থানীয় কর্মকর্তারা অভিবাসীদের ক্যা¤েপর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। তাতে মিসেস থমসন সরাসরি উপকার না পেলেও অন্যরা পেয়েছে। মিসেস থমসন ব্যাপারটি ভুল বুঝেছেন’। তার এই জবাব শুনে ফটোগ্রাফির গভীরে বসত করা একটা ফাটল আমার কাছে পরিষ্কার হল। একটি ডকুমেন্টরি ফটোগ্রাফির দুটো মুহূর্ত ধরা পড়েঃ প্রথমটি তাৎক্ষণিক, কেজো উদ্দেশ্য পূরণ করে। যেখানে বাস্তবতার নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা থেকে একটা অংশ তুলে আনা হয় বা তৈরি করা হয় প্রতিনিধিত্ব শীল সাক্ষ্য হিশাবে। একেবারে আইনি অর্থে প্রামাণ্যের দাবি নিয়ে কোন সামাজিক প্রথার পক্ষে বা বিপক্ষে আদর্শিক বা তাত্ত্বিক সমর্থন জ্ঞাপন করে। দ্বিতীয়টি প্রথাগত ‘নান্দনিক- ঐতিহাসিক’। এইখানে চৌহদ্দিটা অনেক আলগা। সামাজিক ভূমিকা গৌণ, নান্দনিকতাই মুখ্য। অর্থাৎ একটি আলোকচিত্র দর্শকের চিন্তা উসকালো কি না তা বিবেচ্য নয়। দর্শকের দিলের মাঝে নান্দনিক আনন্দের হিল্লোল বয়ে দিতে পারল কিনা সেটাই সাফল্যের পরিচায়ক। সেটাই একটা ছবি কতটা সুসংগঠিত হয়েছে তা বিচারের মাপকাঠি। অর্থের কোন ঐতিহাসিক নির্দিষ্টতা না মানা আসলে অনৈতিহাসিক অবস্থান গ্রহণের নামান্তর। কিন্তু সময়ের দিক থেকে ছবিটি যে অতীতের গর্ভে নির্মিত সে বিষয়ে আবার তা ‘ইতিহাস মনষ্কতা’ বজায় রাখে। ছবির ব্যাখ্যা বা রাজনৈতিক ও রূপকার্থের মধ্যে দাণ্ডিক স¤পর্ক অস্বীকার করে গোপন অর্থ আবিষ্কার করার এই প্রবণতাটি সত্যিই বিপজ্জনক। এই মার্গের সাধুরা মনে করে শিল্প তথা আলোকচিত্রের সুনির্দিষ্ট বাধন সূত্র আলগা হলে কিংবা সময়ান্তরে তা আবছা হয়ে আসলে বরং সারবত্তা সমঝানো সহজ হয়। কারণ তখন এর নান্দনিক রূপ প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। (যদিও আবার সামাজিক মনোভাব নামক অস্পষ্টতার কুশনে পেতে রাখে যাতে শেষে ছবি রহস্যময়টায় খাবি না খায়।) আমার দাবি মতাদর্শ নিরপেক্ষ নন্দনতত্ত্ব বলে কিছু নাই। ইমেজের প্রতি আমাদের সম্পর্কের যেকোনো ধরনই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি জাত, আরও খাস করে বললে সাংস্কৃতিক উৎপাদনের সামাজিক বোঝাপড়ার ভিতরে নিহিত। (ডরথির প্রকাশিত মন্তব্য ধর্তব্যে নিলে এমনই মনে হয় যে, তিনি এই সামাজিক বোঝাপড়া সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, কিন্তু সাংস্কৃতিক আত্মীয়করণের প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে অনেক আগেই কাজটি এই পরিপ্রেক্ষিত হারিয়ে বসেছে।)
বাস্তবে আলোকচিত্র চর্চার ক্ষেত্রে এরকম ধারণা প্রয়োগের সমস্যা হল, এটা ভুলে যায় যে, সঠিক নন্দন তাত্ত্বিক ভাবনারও বদল ঘটে। কারণ এটা এই সত্য এড়িয়ে যায় যে, নির্দিষ্ট বৈষয়িক বাস্তবতা ছাপিয়ে যেতে সক্ষম অর্থের বিভিন্নতা নয় বরং ঐতিহাসিক স্বার্থই কোন রূপ বা কাঠামো অর্থ প্রকাশে পর্যাপ্ত কিনা তা নিয়ন্ত্রণ করে। সবচে বড় কথা ইতিহাস আপনাকে দুই বার আন্দাজ করার সুযোগ দেয় না। আলোকচিত্রের প্রথাসিদ্ধ (ষবমরঃরসধঃব) ইতিহাসে জেকোভ রিসের পাশাপাশি লুইস হাইন, আর্থার ফেলিগের সাথে জানি লিওন যে, একত্রিত হয়েছে তার হেতু নান্দনিক অভিযোজনগত স্বভাবে। স্পষ্টতই ডরথি ও লেবার ফটোগ্রাফার-এর মত যারা কাঁচা ইন্দ্রিয়কে অর্থ সঞ্চারের শক্তিশালী উপায় সমঝেছেন তারা ধ্রুপদী সৌন্দর্যতত্ত্বের অপরিসীম মতাদর্শিক শক্তির বিরুদ্ধতা করছিলেন। এই ধ্রুপদী সৌন্দর্যতত্ত্ব মতে সর্বজনীন রূপের সন্ধানে নেমে দুনিয়া থেকে আমরা কেবলমাত্র শ্বাশত নান্দনিকতার আভাস পেতে পারি।
বর্তমানে শিল্পকর্ম মাত্রেই প্রেক্ষিত বিচ্ছিন্ন করে দেখার যে, সাংস্কৃতিক ধুন্দমার চলছে তার ফলে এই বিষয়টি অনুধাবন প্রকারান্তর অসম্ভব। বিশেষত, ল্যাঙ এবং লেবার ফটোগ্রাফারের মত যারা তারা এবং তাদের কাজকে কার্যত অবমূল্যায়নই করা হয়। কাজের সাথে আলোকচিত্রীর নিজের যে সম্পর্কটা আমার মনে হয় আমি তা ভিতর থেকে বুঝি। সত্যিকার অর্থে তাদের অনুমিত স্বেচ্ছাধীনটা বলতে বুঝায় নিজের সমগ্র কাজের ভিতরে ঐ বিশেষ ছবির অবস্থান এবং ফটোগ্রাফির দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ততা। কিন্তু আমি একইসাথে আত্মরক্ষামূলক এই জোরাজুরি দেখলে ধৈর্য ধরতে পারি না। এটা এমনকি যে কারও মহৎ উদ্দেশ্যকেও শেষমেশ শোষকের হাতে হাতিয়ার বানায়।