ঘুম যখন বিরতি

আলাপচারিতা- শহিদুল আলম

মুনেম ওয়াসিফ

 

স্যালন থেকে সোশাল

মুনেম ওয়াসিফ: তো আপনি বিপিএস ছাইড়া দৃক করলেন কেন? আপনি ফটোগ্রাফি নিয়া অন্য কিছু ভাবসিলেন যেইটা বিপিএস এ করা সম্ভব ছিল না?

শহিদুল আলম: বিপিএস নিয়ে আমার কোনই সমস্যা ছিল না। বিপিএস আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। এবং আমি প্রতিষ্ঠানটাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি। যেটা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল যে, বিপিএস এর বাইরেও একটা জগত আছে। যদিও বা আমি এই ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি বা কিছু কিছু মাধ্যমে এই বাইরের জগতের সাথে পরিচিত করার চেষ্টা করেছি, এইটা একটা শৌখিন আলকচিত্রীদের জায়গাই ছিল। পেশাজীবী আলোকচিত্রীদের জায়গা সত্যিকার অর্থে ছিল না। সুন্দর ছবি করা ছিল বিপিএস এর আকর্ষণ, ছবির মাধ্যমে যে একটা কাজ করা সম্ভব সেইটা না। সমাজ পরিবর্তন, ছবির মাধ্যমে একটা আন্দোলন করা, ছবির মাধ্যমে একটা বক্তব্য প্রকাশ করা, ছবির মাধ্যমে প্রতিবাদ করা-এই বিষয়গুলো বিপিএস-এর ছিল না। এটাকে ভাল-খারাপ বলছিনা, বিপিএস এর এই জায়গাটাই ছিল না। এটা একটা দিক। আরেকটা হল, আমি যখন পাশ্চাত্যে বাংলাদেশকে কিভাবে দেখা হয় সেটা দেখি, সেখানে বাংলাদেশকে খুব নেতিবাচক ভাবেই দেখা হত। এখনও অনেক ক্ষেত্রে দেখা হয়। এবং এটা পরিবর্তন করার ব্যাপারে আমাদের কোন ভূমিকাই নেয়া হত না। যদিও বিপিএস সাংবাদিকতা করত না, কিন্তু যেই ক¤পিটিশনগুলো ওরা করত, সেখানে সুন্দর ছবি যেমন যেত, দারিদ্র্যও তেমনি থাকত। কিন্তু জীবন সম্বন্ধে বলার জায়গাগুলি সেভাবে ছিল না। তখন মনে হল স¤পূরক একটা কিছু হওয়া দরকার। বিপিএস গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে, সেটা ঠিক আছে। সেই সাথে স¤পূরক একটা কিছু থাকা দরকার যেখানে আলোকচিত্রটাকে পেশা হিশাবে নেয়া যাবে। যেখানে সত্যিকার অর্থে পেশাজীবীদের জন্য একটা মঞ্চ তৈরি হবে। যেখান থেকে তারা তাদের কাজ দেখাতে পারবে, ছবির একটা ভাষা আসবে, এবং তারা ছবির মাধ্যমে প্রতিবাদও করতে পারবে। সেই রকম চিন্তা থেকেই দৃক শুরু।

 

মুনেম ওয়াসিফ: দৃক এর প্রথম দিকের কিছু ক্যালেন্ডার দেখলে বলা যায় যে আপনি সুন্দর বাংলাদেশের ছবি থেকে আস্তে আস্তে সরে আসছিলেন, যেখানে শ্রেণী বৈষম্য, লিঙ্গীয় অসমতা, নানান রাজনৈতিক অস্থিরতার ছবি উঠে আসছিল। আপনি সোশাল ডকুমেন্টারি বা ফটোজার্নালিস্টিক কাজের প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন, যা দিয়ে সমাজকে পরিবর্তন করা যায়? কিন্তু দৃক এর এই সোশাল ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি প্রমোশন ফটোগ্রাফিকে খুব একমুখী করে দিয়েছে? যার ফলে আমরা ৯০’এর দশকে খুব একটা এক্সপেরিমেন্টাল কাজ দেখি নাই। আমি শুধু স্যালন ফটোগ্রাফির কথা বলছি না।

শহিদুল আলম: দৃক যখন শুরু হয় তখন যেই জিনিসটা চেষ্টা করা হয় যে, আমাদের কাজ পৌঁছে দেয়া। তখন শ্রম দেয়া হয় ওই নেটওয়ার্কটা তৈরি করার জন্য। কাঠামো তৈরি করা, আলোকচিত্রীদের একটা ভাল প্রিন্ট করার জায়গার ব্যবস্থা করা। আমরা কিছু কিছু জিনিস করি যা ফটোগ্রাফির সাথে একেবারেই স¤পৃক্ত না, কিন্তু হয়েছিল বলেই এখন ফটোগ্রাফি সম্ভব। আমরা ই-মেইল চালু করি নব্বই দশকের শুরু দিকে। কারণ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা লন্ডন-প্যারিসে থাকব না, বাংলাদেশেই থাকব, কিন্তু আবার তাদের সাথেই আমাদের লড়াই করতে হবে। সেই লড়াইয়ের হাতিয়ারগুলি তৈরি করা। একটা বড় সময় গেছে আমাদের ওই জিনিসগুলি দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে। এবং প্রথম যেই জিনিসগুলি হয়েছে যে দৃকের ক্যালেন্ডারগুলি যখন হয়, তখন দু’টো জিনিস ভিন্ন হয়। তার আগের সকল ক্যালেন্ডার ছিল রঙ্গিন। সাদা-কালো শুধুমাত্র ছাপানো হত বাজেট কম থাকলে। ভাল কাজের জন্যও যে সাদা-কালো হতে পারে, এই বোধ কিন্তু ছিল না। আমরা যখন প্রথম ক্যালেন্ডার করি, সাদা-কালো তো করিই, সেটাকে আমরা আবার স্ক্যান করি। এটা ছিল অদ্ভুত একটা চিন্তা। কারণ সস্তা করার জন্য যেখানে সাদা-কালো করা হয়, প্রসেস ক্যামেরায় সেপারেশন করা হয়, সেখানে স্ক্যানিং-এ গেলে তো রঙ্গিনই করতে পারতাম! এবং আমরা প্রথম ক্যালেন্ডার করি স্ক্যান করে সাদা-কালো এক রঙ্গে। দ্বিতীয় ক্যালেন্ডার করি স্ক্যান করে ডুয়ো-টোন। তৃতীয় ক্যালেন্ডার করি স্ক্যান করে সাদা-কালো ফোর কালারে! এটা তো তখন একটা অদ্ভুত জিনিস! আমি চার রঙ্গেই ছাপাচ্ছি, স্ক্যান করছি, কিন্তু সাদা-কালো ছাপাচ্ছি, ব্যাপারটা কি! এটা বোঝা খুব কঠিন ছিল। এবং তার মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আনার প্রয়োজন ছিল কারণ ক্যালেন্ডার সংস্কৃতির মধ্যে ফুল, সুন্দরী মহিলা, মসজিদ বা ল্যান্ডস্কেপ-এই চারটা বিষয়ের বাইরে ক্যালেন্ডারে কোন বিষয়বস্তু হত না! ক্যালেন্ডারের মধ্যেও যে বিষয় আনা সম্ভব, এবং ক্যালেন্ডার যে সাদা-কালো হতে পারে দু’টোই কিন্তু নতুন একটা ব্যাপার।

মুনেম ওয়াসিফ: আপনি দৃক করার কারণে কি বিপিএস বা পূর্ববর্তী ফটোগ্রাফারদের সাথে কি কোন দূরত্ব তৈরি হয়েছিল?

শহিদুল আলম: দৃককে যখন ভিন্নভাবে দাঁড় করানো হয়, সবাই যে এটা বুঝেছে বা পছন্দ করেছে তা-ও না। কারও কারও হয়ত ধারণা ছিল এটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েকটা জিনিস তো আমরাও করি, যেটা ওরাও করে। যেমন প্রদর্শনী করি, ফটোগ্রাফি ক¤পিটিশন করি, আরও বিভিন্ন ধরনের জিনিস করি। তবে আমরা থেকে থেকেই যৌথভাবে কাজ করেছি। কিছু কিছু জিনিস যেটা আমি মনে করি হয়ত বিপিএস-এরই করা উচিত ছিল, করা হয়নি বলে আমরা করেছি। যেমন, গোলাম কাশেম ড্যাডি এবং মনজুর আলম বেগ এর যৌথ একটা প্রদর্শনী আমাদের এখানে হয়, ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’ বলে। এইটা ঠিক যে আমার তখন জায়গা বেশি ছিল, করার সুযোগও বেশি ছিল। তবে শুরুর দিকে দৃক যে ফটোগ্রাফি চর্চার ক্ষেত্রে খুব বেশি ভিন্নতা করেছে তা না। ভিন্ন একটা দিক নিয়ে কাজ করেছে। বিপিএস বিপিএস-এর মতই ছিল এবং সমান্তরালভাবেই কিছুদিন চলেছে। যেটা হয়েছে, যেহেতু আমরা ডকুমেন্টারি কাজ অনেক বেশি করছিলাম তখন ওইদিকে জোর বেশি পড়েছে, অন্যান্য দিক হয়ত তুলনামূলক ভাবে কম হয়েছে। আমাদের আসলে তখন ফটোগ্রাফির প্র্যাকটিস নিয়েও ততটা ব্যস্ততা ছিল না, কাঠামো দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে ছিল।