এমদাদুল হক
দৃশ্যত সহজ ও সাধারণ, প্রকৃত প্রস্তাবে জটিল, অসাধারণ এবং মাঝে মাঝে রহস্যময়; প্রায়শই ম্যাজিক মনে হয়। মলাটের ভিতরের পাতাগুলো ঘোরাচ্ছন্ন করে রাখে আমাকে। সাদা-কালো ছবি, প্রতি পাতায় বিস্ময়! ছবির চরিত্রগুলা আসে পুরাণ থেকে, আসে দৃশ্যকাব্য থেকে, আসে কোন এক উপন্যাস থেকে কিংবা এ সকল চরিত্ররাই পরবর্তীতে হয়ত বাস্তব থেকে পুরাণে যায় কিংবা দৃশ্যকাব্যে জায়গা করে নেয়। চরিত্রগুলোর চেহারার গড়ন, অভিব্যক্তি একরকমের নাটকীয়তার জন্ম দেয়। ছেষট্টিটি ছবি সম্বলিত তার একখানা চটি বই; আমার বিছানায়। আমি তারে খুঁজি, খুঁজতে থাকি, ক্ষণে ক্ষণে, অনেক সময় আবার প্রায় সময়। তারে পাই না; তার আলোকচিত্র নিয়েই আমি সন্তুষ্ট থাকি, থাকতে হয়। তারে বোঝার চেষ্টা চালাই। সে আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে অবস্থান করে। বুঝি না পুরোপুরি, বুঝতে চাই, আরও জানতে চাই।
ব্যাগ ভর্তি ফিল্ম লইয়া অনেকদিন পর নিজের পাড়ায় ফেরত আসেন, ফিল্ম ডেভেলপ করেন কিংবা করেন না, কন্ট্রাক প্রিন্ট করলেন কিংবা করলেন না; আবার ব্যাগ ভর্তি নতুন ফিল্ম নিয়া বাইরইয়া গেলেন! মানুষটার কি ঘর সংসার নাই? বউ পোলাপাইন নাই? আমি ধন্দে পইড়া যাই।
বড় ভাই কয় লোকটা ক্যামেরা আর স্লিপিং ব্যাগ নিয়া ঘুইরা বেড়ান পথে পথে, তার আসলে কোন নির্দিষ্ট জায়গা নাই, যখন ছবি তুলতে বের হন তখনও তিনি জানেন না কই যাইতাছেন, স্লিপিং ব্যাগটা যখন রোল করে তখনও লোকটা নিশ্চিত না আইজ কোথায় রাইত কাটাইব! ঘুম যদি এতই জরুরি হয় তাইলে যে কোন জায়গাতেই ঘুমানো যায়, তাই এই বিষয়ে উনি চিন্তিত না। তিনি হাঁটেন আর ছবি তোলেন, ছবি তোলেন আর হাঁটেন। দিনের আলো ডুব মারলেই কেবল তিনি হাঁটা বন্ধ করেন, যেখানে হাঁটা থামান, সেইখানেই নরম ঘাসের উপর স্লিপিং ব্যাগটা বিছান, আর ভোরের আলোয় পাখির ডাকে প্রত্যুষে জাইগা উঠেন; একই জায়গায়! আবার হাঁটতে শুরু করেন। এইটাই তার জীবন! কয় কি হালায়? এমন ‘ছবি পাগলা’ তো জীবনে কম দেখছি। একদিন বৃদ্ধ হবেন, ছবি তুলতে আর সক্ষম থাকবেন না, এই বোধ থেকেই হয়ত এই লোক তার জীবনের প্রতিটি দিন ছবি তুলতেছেন। অথচ কেউরে ছবি দেখান না। বছরের পর বছর পইড়া থাকে তার নেগেটিভ। প্রিন্টও করেন না। দশ হাজার নেগেটিভ এখনও প্রিন্ট হয় নাই! তাইলে কেন ছবি তোলে লোকটা? দিনে দিনে অনেক কথা জমাইয়া রাখছি তারে জিগামু বইলা, কোন এক দিন কাছে পাইলে, প্রথমে একটা সালাম দিমু। পরে একটু সেলাম করুম তারপর জিগামু শইলটা ভালা?
হাঁটতে হাঁটতে ঢুইকা পরলেন পূর্ব ইউরোপের স্লোভাকিয়ার ক্লেনোভ্যেকের একটা রুমের মইধ্যে; আশ্চর্য হই, আপনে মানুষের এমন অভিব্যক্তি কি কইরা তোলেন? আমি খুঁইজা পাই না। মানুষজনের কি কোন সংশয় নাই আপনেরে নিয়া? নাকি আপনেরে কেউ পর ভাবে না? আপনে কি তাদের আপন লোক? ছবির লোকটা বিমর্ষ ছিল বেশ, হয়ত তার মন খারাপ, হয়ত তার পরিবারের কেউ মারা গেছে কিংবা অন্য কোন কারণে তার মনে বেজায় কষ্ট। হয়ত লোকটা কাঁদতে ছিল মহিলাটার সামনে। তখন মহিলাটা হয়ত সেই মানুষটার কান্না সহ্য করতে না পাইরা মানুষটার মাথা বুকে জড়াইয়া ধরল তার ডান হাতে, মানুষটারে শান্ত করার চেষ্টা করতাছিল, ভরসা দিতাছিল, ¯েœহ দিয়া কষ্ট ভুলাইয়া দিতাছিল, মহিলাটা বইসা ছিল একটা জানালার সামনে। জানালায় একটা সাদা পাতলা পর্দা আছিল, আর লোকটা দাঁড়ায়া ছিল মহিলাটার পাশে। লোকটার হাত ঝুলতেছিল। এই বিমর্ষতার মাঝে হয়ত একটু আশ্রয় খুঁজে পাইল লোকটা, তাদের চেহারায় এক ধরনের বিমর্ষতা বর্তমান থাকল; সেই ছবি আপনে তুললেন। আবার মহিলাটা আপনার দিকে তাকাইয়াও ছিল! আচ্ছা, মানুষগুলার কি এত দুঃখ?
তার ছবির বিশ্লেষণ আমি জানি না, বুঝি না, পারি না, পারি নাই। শুধু জানি তার ছবি আমাকে মোহিত করে। কোন কিছুর মোহে পড়লে, মোহের কারণ যদি জানা যায় তাইলে নাকি এইটারে ভালোলাগা কয় আর যদি কারণটা পাওয়া না গেল, তারে নাকি কয় ভালবাসা। এমন একটা ভালবাসা হইয়া গেছে এই মানুষটার ছবির সাথে। আমি আরও কাছে যেতে চাই। প্রেম বাড়তে থাকে…